উপ-সম্পাদকীয়

রপ্তানি খাতের বন্ধুদেশ স্পেন

  প্রতিনিধি ১২ অক্টোবর ২০২৪ , ৭:৩৯:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ

রপ্তানি খাতের বন্ধুদেশ স্পেন

খায়রুল আলম সুজন :: ১২ অক্টোবর স্পেনের জাতীয় দিবস। বছরের পর বছর ধরে স্পেন এবং বাংলাদেশ পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা এবং উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। স্পেনের জাতীয় দিবস উপলক্ষে দুই দেশের বন্ধুত্ব ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্মরণ করা যাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই স্পেন এবং বাংলাদেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীতে। পশ্চিম ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে স্পেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, যা একটি স্থায়ী সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে। গত পাঁচ দশক ধরে উভয় দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী থেকেছে।

স্পেন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের পারস্পরিক অংশ গ্রহণের মাধ্যমে আরও জোরদার হয়েছে, যেমন জাতিসংঘে। এখানে উভয় দেশ বৈশ্বিক শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং আইনের শাসনের পক্ষে কথা বলে। এই অভিন্ন মূল্যবোধ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে, যা ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির ভিত্তি স্থাপন করেছে। স্পেন-বাংলাদেশ সম্পর্কের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভগুলোর একটি হলো বাণিজ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার স্পেন। তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। স্পেনের ফ্যাশন খাতের অনেক কোম্পানি, যেমন ইন্ডিটেক্স (জারা’র মূল প্রতিষ্ঠান) এবং ম্যাঙ্গো, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা। পোশাকশিল্প দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি চালিকাশক্তি। সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চমানের পোশাকের চাহিদা উভয় দেশকে এক সুতায় গেঁথেছে। স্পেন বাংলাদেশে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক পণ্য এবং কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করে। তবে স্পেন থেকে আমরা যা আমদানি করি, তার চেয়ে বেশি রপ্তানি করি। অনেকে দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। তবে স্পেনের ক্ষেত্রে রপ্তানি বাণিজ্য প্রতি বছরই বাড়ছে।

এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও স্পেনে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের আকার ছিল ৩৭৪ কোটি ডলার। এ সময়ে বাংলাদেশ স্পেনে রপ্তানি করেছে ৩৫১ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে ৩৪১ কোটি ডলার হলো তৈরি পোশাক। এর বাইরে প্রায় ১০ কোটি ডলারের চিংড়ি, চামড়া, জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে বাংলাদেশ স্পেন থেকে আমদানি করেছে ২৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ স্পেনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হলো ৩২৮ কোটি ডলার। এ যেন আমাদের রপ্তানি খাতের অকৃত্রিম বন্ধু। গত পাঁচ বছরে স্পেনে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশটিতে গড়ে ১২ শতাংশ হারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আমাদের রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে স্পেনে সরাসরি জাহাজ সার্ভিস আবারও চালু করার সুযোগ আছে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ২০২২ সালের জুনে নেদারল্যান্ডস ও স্পেনে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি জাহাজে কনটেইনার পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল। অবশ্য ২০২৩ সালের আগস্টে নেদারল্যান্ডস-স্পেন রুট বন্ধ হয়ে যায়। এটা ঠিক, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে মাতারবাড়ী থেকে সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকায় বড় জাহাজ চলাচল শুরু হবে। তখন খুব কম সময়ে রপ্তানি পণ্য স্পেনের ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। এখন সিঙ্গাপুর, কলম্বো বন্দরের মতো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহন করতে হবে না।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকায় দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান এবং একটি উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে তার অবস্থান বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয়। আমাদের রয়েছে সস্তা শ্রম সুবিধা। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি, অবকাঠামো এবং পর্যটন খাতে বাংলাদেশে স্পেনের নতুন বিনিয়োগের গন্তব্য হতে পারে। পর্যটন এবং আতিথেয়তা খাতেও সহযোগিতার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটনে নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে স্পেন, বাংলাদেশের পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়নে, যেমন হোটেল ও বিনোদনমূলক পরিষেবা, তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে। এটি উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হতে পারে, কারণ বাংলাদেশ তার পর্যটন আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে চায়। স্পেনের বিনিয়োগকারীরা নতুন বাজারে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে। এছাড়াও টেক্সটাইল খাত, প্রযুক্তি, কৃষি এবং ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো খাতে বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ রয়েছে। উদীয়মান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতও স্পেনের কোম্পানিগুলোর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রবেশের সম্ভাবনা রাখে।

বাংলাদেশ ও স্পেনের মধ্যে শুধু ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়, বরং সাংস্কৃতিক সম্পর্কও উল্লেখযোগ্য। দুই দেশের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমেও বন্ধন গড়ে উঠেছে। স্পেনে প্রায় বিশ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। একইভাবে, স্প্যানিশ পর্যটকরা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণ করছেন, যা দুই দেশের মধ্যে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সহায়ক হচ্ছে। বাংলাদেশ ও স্পেনের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রেও সহযোগিতার সম্ভাবনা অনেক। দুই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বিনিময়, গবেষণা প্রকল্প এবং শিক্ষাবৃত্তির সুযোগ রয়েছে।

স্পেন যখন জাতীয় দিবস উদযাপন করে, তখন এটি স্পেন এবং বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী ও ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের প্রতিফলন করার একটি উপযুক্ত মুহূর্ত। দুই দেশের বন্ধুত্বের ভিত্তি কেবলমাত্র অভিন্ন মূল্যবোধের ওপর নয়, বরং একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ওপর নির্ভর করে যা আরও বৃদ্ধি ও উন্নতির সুযোগ রয়েছে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে এই সম্পর্ককে আরও গভীর করতে থাকলে, স্পেন এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরও গভীর সহযোগিতা ও পারস্পরিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। তাতে শুধু স্পেনই নয়, বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে।

লেখক : সদস্য, স্পেন-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি