ঢাকা

করতেন ভিক্ষা থাকতেন অন্যের ঘরে, এবার পেয়েছেন নিজের ঘর

  প্রতিনিধি ১৭ আগস্ট ২০২১ , ৬:৪৫:১৩ প্রিন্ট সংস্করণ

এমদাদুল হক, শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধিঃ

 

দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার গৃহহীনদের জন্য ঘর ভেঙ্গে যাওয়া, দেবে যাওয়া, ধসে পড়াসহ নানা খবরের ভেতরে গাজীপুরে শক্ত, মজবুত ঘর নির্মাণের খবর পাওয়া গেছে। তবে ঘর মজবুত হওয়ার পেছনে ভৌগলিক অবস্থান ও মাটির বিশেষত্বের কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ঘর পেয়ে গৃহহীন মানুষেরা বেজায় খুশি ও সন্তুষ্ট হয়েছেন। গৃহহীন এসব মানুষদের অনেকে বছরের পর বছর অন্যের বাড়িতে ভাড়া থেকে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে নিজ ঘরের ঠিকানা পেয়েছেন। আবার অনেকে দুই যুগ পর নিজের ঘরে ঈদুল ফিতর উদযাপনের অভিজ্ঞতারও বর্ণনা করেছেন।

শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের পাঠানটেক গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে উপকারভোগী সারকুল বলেন, ঘরগুলো মজবুত ও শক্ত হয়েছে। গাজীপুরের বেশিরভাগ এলাকার মাটি লাল ও শক্ত। ফলে ঘরগুলো নির্মাণেও মাটি ভরাট করতে হয়নি।

করতেন ভিক্ষা থাকতেন অন্যের বাড়িতেঃ

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের বরামা গ্রামের সখিনা বেগম তার আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, বাড়ি-ঘরতো নাইগা। বাড়ি-ঘর যদি থাকত বাবা, তে আর এহেনো (এখানে) আইলাম অইলে (আসতাম)? মাইনসের বাইত(বাড়ি) রইছি (থেকেছেন)। একটা ছেলে থাহে হউর (শ^শুর) বাইত ছুডু (ছোট) ছেলেডারে লগে (সাথে) রাহি (রাখি)। আর চাইট্টা (৪) মেয়ে বিয়া দেয়ালছি। আমি বহুত বছর দইরা (যাবত) বাইরে থাকতাছি। বরামা গেরামে আছলাম (ছিলেন) মাইনেসর বাইত-ই। ভিক্ষা-চিক্কা হইরা ভাড়াও দিছি, কিছু খাইছি বাবা, কিছু পেটটা বাঁচাইছি, মিছা কতা কইলে বাবা লাভ নাই।। এনো (এখানে) উড়ছি (উঠেছেন) মাসেক খানে দরে দরে (এক মাসের কাছাকাছি)। খুব কষ্ট হইরা বাবা আল্লাহ দয়া হরছে (করেছে)। হাছিনা দিছে। অনে(এখন) এট্টু বালাই(ভাল) লাগতাছে বাবা। নিজের বাড়ির মতোন, ঠাঁই মতোন(নিশ্চিত নিজের বাড়ি)। বিত্তে (মনের ভেতর) কোনো ডুরকুড়ি (ভয়) নাই, যে একজনে কইতারতো না (বলতে পারবে না) যে, এই বেডি বাড়া (ভাড়া) দিছত(দেওয়া) না যাইগ্যা (চলে যাওয়া)। তর বাড়া কবে দিবে? এলিগ্যা(এজন্য) আমার এট্টু আনন্দ অইছে বাবা। ভিক্ষা করলেও এখন নিজের ঘরে থাকি শান্তি লাগে।

 

১৭ বছর ছিলেন নিজ গৃহছাড়াঃ
বরমী ইউনিয়নের গোলাঘাট ভিটিপাড়া গ্রামের সাদিকুল ইসলাম (৩২)। তিনি বলেন, যাদের বাড়ি-ঘর নেই তারাই বুঝে নিজের বাড়ি-ঘর না থাকার যে কী যন্ত্রণা। অভাবের কারণে বাবা ভিটে-বাড়ি বিক্রি করেছেন ছোটকালে। নিজের বাড়িতে ১৫ বছর বড় হয়েছেন। বাকি সময় মানুষের বাড়িতে থেকে বড় হয়েছেন। একেক সময় একেক বাড়িতে ভাড়া রয়েছেন। কখনো এলাকায় কখনো এলাকার বাইরে। বাড়ি পেয়ে মনে হচ্ছে তাঁর ভেতর থেকে একটা কিছু হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা তিনি ফিরে পেয়েছেন। গেল ঈদুল আযহা পালনের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, এই ঈদে মনে হয়েছে তিনি বহুদিন পর তার নিজের বাড়িতে ঈদ করেছেন। ঘর পেয়ে নিজের অস্তিত্ব পেয়েছেন বলে অনুভব করছেন। তিনি ঘর পেয়ে অনেক সন্তুষ্ট এবং শান্তি পেয়েছেন বলে দাবী করেন। ঘরগুলো মজবুত এবং যতটুকু পেয়েছেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।

জীবনে বাড়ি-ঘর হারানোর পর আধা পাকা বাড়ি পেয়েছেন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, উন্নত পয়:নিস্কাশন ব্যবস্থা পেয়ে খুব ভাল বোধ করছেন। টয়লেট, রান্না ঘর, থাকার ঘর সংযুক্ত থাকায় খুশি হয়েছেন।

মাসশেষে কাউকে ঘর ভাড়া দিতে হবে নাঃ
অশীতিপর হযরত আলী বলেন, একটি ঘরের জন্য উপ-সহারী ভূমি কর্মকর্তা, উপজেলার রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সবার কাছে গিয়েছেন গিয়েছেন। অবশেষে একটি ঘর পেয়েছেন। তিনি বলেন, আগে মানুষের বাড়িতে ভাড়া থেকেছেন। ভিক্ষা বৃত্তি করে মাস শেষে দুই, আড়াই, তিন হাজার টাকা ভাড়ায় থেকেছেন। জীবনে বাড়ি পাল্টিয়েছেন বহুবার। এখন সেসবের কোনো ঝামেলা নেই। মাসশেষে কাউকে ঘর ভাড়া দিতে হবে না। কমপক্ষে ২৫ বছর বাইরে থেকে নিজের ঘরে উঠেছেন তিনি।

টয়লেট ও গোসলখানা একসাথে হয়ে যেতঃ
গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ভৌড়াঘাটা এলাকার মৃত আলী আহমেদের স্ত্রী আমিরুন্নেছা (৮৮) বলেন, একটা পাকের ঘর, বাথরুমসহ দুটি ঘর পেয়েছেন। তবে গোসলখানা ও রান্না ঘরে সানসেট দেওয়া হয়নি। টয়লেটের সামনে জায়গা না রেখে সংযুক্ত করে দিলে টয়লেট ও গোসলখানা একসাথে হয়ে যেত। এখন গোসলখানা নেই। রান্না ঘরে কিছু রাখতে গেলে বাড়তি জিনিস ব্যবহার করতে হবে। আগে অন্যের বাড়িতে বাড়িতে থাকতেন। স্বামীর বাড়ি ফরিদপুর। বাবা-মা ভাই-বন্ধু কেউ নেই। একটা বোন ছিল। সেই বোনের বাড়ি ছিল ভৌড়াঘাটা সরকারি খাসের মধ্যে।

মুলামুলিরটেক এলাকার মৃত আইনুদ্দীনের স্ত্রী উপকারভোগী এশা বেগম বলেন, তাদের এলাকায় ঘর নির্মাণে নতুন করে মাটি ভরাট করতে হয়নি। বন্যা বা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না এমন জায়গায় ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এসব জায়গায় ঘর নির্মাণ ছাড়া মাটি ভরাট বা জলাবদ্ধা নিরসন করতে হবে এমন কোনো কাজ করতে হয়নি।

তেলিহাটী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বাতেন সরকার জানান, তাঁর এলাকায় ২০ জন গৃহহীন মানুষ গৃহ পেয়েছে। তারা সবাই ওইসব ঘরে বসবাস করছে। সম্প্রতি যে পাকা ঘরগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর অনুদান যখন যা পাওয়া যাচ্ছে নতুন ঘরের বাসিন্দাদের তা থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। ঈদের সময় সকল প্রকার সরকারি ভাতা ছাড়াও কোরবানীর মাংস দেয়া হয়েছে প্রত্যেক পরিবারে। কিছু দিনের মধ্যে আরও অনুদান আসবে। সেখান থেকেও তারা সহায়তা পাবে।

 

আরও খবর

Sponsered content

Powered by