বিলুপ্তের পথে দেশের প্রথম রেলস্টেশন

আরিফুজ্জামান, কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ার জগতি, বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ আমলে তৈরি ১৫৮ বছর বয়সী রেল স্টেশনটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ রেলস্টেশনে দু’টি লোকাল ট্রেন ছাড়া আর কোনও ট্রেন থামে না। যে স্টেশন জুড়ে থাকতে মানুষের ব্যস্ততা, জ্বলেছে চকচকে আলো, সেখানে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ। পরিত্যক্ত দ্বিতল ভবনটি এক সময়ের বিখ্যাত জগতি রেলস্টেশন। ভবনে ফাটল ধরায় উপর তলাতে যাওয়া নিষেধ। ভেঙে পড়েছে ওয়েটিং রুম আর ক্ষয়ে গেছে প্ল্যাটফর্ম। ১৯৮৪ সালেও যেখানে ২৬ জন কর্মকর্তা ছিল এখন সেখানে এখন মাত্র একজন কর্মকর্তা পাহারা দিয়ে রেখেছেন স্টেশনটি। জগতি রেলস্টেশন দেখাশোনার জন্য দায়িত্বে নিয়োজিত পিম্যান বিল্লাল হোসেন বলেন, আমি এখানে সাত বছর আছি। এই সাত বছর আগেও এখানে ছয়জন স্টাফ ছিলাম। এখন শুধুমাত্র আমি স্টেশনটি পাহারা দিয়ে রেখেছি। স্টেশনের পাশ দিয়ে একটি রেল গেট রয়েছে মাঝে মাঝে সেটিও আমাকে দেখতে হয়। ট্রেন আসলে আমি ঘণ্টা দেব, নাকি রেল গেট ফেলবো, একা এসব করা যায় না। তারপর বাথরুম নেই, গোসলখানা নেই, এভাবে এখানে থাকা যায় না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বললে তারা বলেন, ইচ্ছে হলে চাকরি করেন না হলে না করেন। বৃদ্ধ বয়সে পেটের দায়ে চাকরি করে যাচ্ছি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে এই জগতিতে রেলপথ ও স্টেশন নির্মিত হয়। পরবর্তীতে এখানে ‘কুষ্টিয়া চিনিকল’ প্রতিষ্ঠিত হলে আখ সরবরাহ ও অর্থনৈতিক কাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই রেলস্টেশন। গেল ৩০ বছর ধরে রেল স্টেশনে চায়ের দোকান দিয়ে বসে আছেন ফিরোজ আলী। তিনি বলেন, একসময় মানুষের ভিড়ে অনেক সময় ট্রেনে উঠাই যেত না। এখন স্টেশনে কিছুই নেই। স্টেশনটি ভালো হলে শুধু আমাদের নয়, সবারই ভালো হবে। বয়সে প্রবীণ আফতাব উদ্দিন বলেন, জগতি খুব বড় স্টেশন ছিল। এরকম দোতালা স্টেশন আমার জানামতে আর নেই। এর সবই নষ্ট হয়ে গেল। মানুষ এখন এখানে ১০ মিনিট বসবে সেই জায়গাও নেই। মাঝে পাথরের দিতে রেল গাড়ি এসে দাঁড়ায়। পাথরওলারা যেটুকু জায়গা রয়েছে সেটিও দখল করে রেখেছে। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ড. আমানুর আমান বলেন, কেন এই স্টেশনের কাজ হয়নি, মূলত এটি আমাদের একটি যন্ত্রণার কারণ। অন্যান্য দেশ হলে এই জগতি রেল স্টেশনটি হতো বিশ্ব হেরিটেজের অংশ। কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি। দেশের প্রথম রেল স্টেশন হিসেবে এটির আরও উন্নয়ন করা দরকার ছিল। কিন্তু কোনও সরকারই এটি করেনি। এর ফলে রেলের ইতিহাসই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটিকে হেরিটেজের অংশ করা উচিত ছিল। এসব বিষয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে জগতি রেলস্টেশনের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে জায়গা দখলমুক্ত করা হবে এবং স্টেশনটি আধুনিকায়ন করতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হবে।