দেশজুড়ে

সিডরের ১৬ বছর, টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় উপকূলে এখনও আতঙ্ক

  প্রতিনিধি ১৪ নভেম্বর ২০২৩ , ৪:৩২:৩২ প্রিন্ট সংস্করণ

সিডরের ১৬ বছর, টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় উপকূলে এখনও আতঙ্ক

প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর শণখোলাবাসীর একটাই দাবি ছিল বলেশ্বর নদের তীররক্ষায় টেকসই একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণের। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উঁচু বাঁধ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা টেকসই হয়নি। কারণ নদী শাসন না করে নির্মাণ করা হয়েছে এই বাঁধ। যার কারণে হস্তান্তর হওয়ার আগেই সেই বাঁধে শুরু হয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। ফলে টেকসই বেড়িবাঁধের সেই কাঙ্খিত প্রত্যাশা পুরণ না হওয়ায় সিডর সংঘটিত হওয়ার ১৬বছর পর এসেও ভীতি আর শঙ্কা কাটছে না মানুষের।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের জলোচ্ছাসে শরণখোলার বলেশ্বর নদের তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডে ৩৫/১ পোল্ডারের নাজুক বেড়িবাঁধের তিনের দুই অংশই বিলিন হয়ে যায়। সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিধ্বস্ত হয় হাজার হাজর ঘরবাড়ি ও গাছপালা। বিপর্যস্ত হয়ে পরে এখানকার অর্থনীতি।

এর পর এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উঁচু ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহন করে সরকার। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি-১) মাধ্যমে ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ায় সময় বাড়ানো হয় দুই দফায় আরো চার বছর। যার ফলে তিন বছরের কাজ শেষ হতে সময় লেগে যায় প্রায় ৭বছর। চলতি বছরের ডিসেম্বরে ‘সিইআইপি’ কর্তৃপক্ষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করবে বলে জানা গেছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদী শাসনের ব্যবস্থা না রেখেই এই মেগা প্রকল্পটি গ্রহন করা হয়েছে। এর পরে মাটির পরিবর্তে বাঁধে বেশিভাগই ব্যবহার করা হয়েছে বলেশ্বর নদের বালু। সরকারে পক্ষ থেকে সঠিক তদারকি না থাকায় যেনোতেনোভাবে কাজ সম্পন্ন করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৬২ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে বলেশ্বর নদের তীরের শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী থেকে মোরেলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী কুমারখালী ফসিয়াতলা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ন বলেশ্বরের ভাঙনে বিলিন হচ্ছে বাঁধ সংলগ্ন জমি।

বলেশ্বর তীরে সিইআইপি-১ নির্মিত বেড়িবাঁধ ঘুরে বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে ভাঙনের ভয়াবহ চিত্র। এর মধ্যে গত ১৮ অক্টোবর সকালে উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা আশার আলো মসজিদসংলগ্ন এলাকার প্রায় ৩০০ মিটার মূল বেড়িবাঁধের সিসি ব্লকসহ ধসে যায়। এর আগেরদিন রাতে মূল বাঁধের সামনে সেনাবাহিনীর জরুরিভাবে নির্মিত প্রায় ৪০০ফুট রিং বাঁধসহ বহিরাংশের কমপক্ষে ১০ বিঘা জমি গাছপালাসহ বলেশ্বরে তলিয়ে যায়। বর্তমানে আশার আলো মসজিদ কাম সাইক্লোন শেল্টার থেকে তাফালবাড়ি পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার মূলবাঁধের ব্লকে ফাটল ও বাঁধের গোড়ায় ভয়াবহ ধস দেখা দিয়েছে।

অপরদিকে, বলেশ্বর তীরের রায়েন্দা ইউনিয়নের চালরায়েন্দা, রাজেশ্বর, জিলবুনিয়া, খোন্তাকাটা ইউনিয়নের রাজৈর মারকাজ মসজিদ, বটতলা, মধ্যখোন্তাকাটা, কুমারখালী এবং মোরেলগঞ্জ অংশের মধ্য বরিশাল ও ফাসিয়াতলাসহ কমপক্ষে ১০টি স্থানে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মধ্য বরিশাল, ফাসিয়াতলা এবং গাবতলা পয়েন্টে জরুরি ভিত্তিতে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং চলমান রয়েছে। তবে, ভাঙনের স্থানের গভীরতা বেশি হওয়ায় সেই জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ে ভাঙনরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের খলিল জমাদ্দার (৬৫) ও সাফায়েত জমাদ্দার (৫৫) বলেন, বাঁধের ভেতরে সবই বালি (বালু)। আর বালি দিয়া বাঁধ করলে তা টেকসই হয় কেমনে? তাও কিছুদিন টিকতো যদি নদী শাসন করা হইতো। দ্রুত নদী শাসন না করলে দুই-এক বছরের মইধ্যেই অনেক স্থানে বাঁধের চিহ্নও থাকবে না।

রাজেশ্বর গ্রামের বাদল খান বলেন, সিডরে বাঁধ ভাইঙ্গা আমাগো এক গ্রামেরই ২৬ জন মারা গেছে। কিন্তু রাজেশ্বর গ্রামের সেই স্থানের বাঁধে কোনো সিসিব্লক বসানো হয় নাই। এখনই এই স্থানে ভাঙন শুরু হইছে। শত শত জীবনের বিনিময় আমার যে বেড়িবাঁধ পাইছি তাতে যেভাবে ভাঙন শুরু হইছে তার ওপর কোনো ভরসা নাই। ঝড়-জলোচ্ছাসের নাম শুনলেই আমাগো গ্রামের মানুষের মইধ্যে সিডর আতঙ্ক শুরু হয়।

রায়েন্দা ইউনিয়নের বলেশ্বর পারের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বাদশা ও টেকসই বেড়িবাঁধ আন্দোলনের তৎকালিন আহবায়ক সাবেক চেয়ারম্যান এম এ রশিদ আকন বলেন, আমরা সিডরের পরে একটি টেকসই বেড়িবাঁধের দাবিতে আন্দোলন করেছি। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উচু বাধ দিয়েছে সরকার। কিন্তু আমাদের সেই টেকসই বাঁধের প্রত্যাশা পুরণ হয়নি। নদী শাসন ব্যবস্থা না করেই বাঁধের কাজ বাস্তাবয়ন করা হয়। সম্পুর্ণ বাঁধটাই বালু দিয়ে করা হয়েছে। ডিসেম্বরে বাঁধ হস্তান্তর করার কথা শুনেছি। অথচ তার আগেই বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন ও ভূমিধস শুরু হয়েছে। সরকারের সঠিক তদারকি না থাকায় চীনা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করে চলে গেছে।

খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন কান মহিউদ্দিন ও সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইমরান হোসেন রাজিব বলেন, বাঁধে যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে আমরা শঙ্কিত। এই বাঁধ রক্ষা করতে হলে নদী শাসনের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সরকারের কাছে স্থায়ী নদী শাসনের দাবি জানাই।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ভাঙনরোধে জিও ব্যাগে বালু ভরে ডাম্পিং চলছে। বর্তমানে গাবতলা, কুমারখালী ও ফাসিয়াতলায় ডাম্পিং চলমান রয়েছে। স্থায়ী নদী শাসনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বলেশ্বর নদের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নদী শাসনের জন্য ডিপিপি তৈরী করে আরো দুই বছর আগে মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। সিইআইপি কর্তৃপক্ষ ডিসেম্বরে আমাদের কাছে বাঁধ হস্তান্তর করবে। হস্তান্তর হলে পরবর্তীতে এব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আরও খবর

Sponsered content