বাংলাদেশ

দ্রুত ড্যাপের গেজেট করা উচিত : বসুন্ধরা চেয়ারম্যান

  প্রতিনিধি ২১ নভেম্বর ২০২১ , ৫:১৩:৩৩ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্ক:

যত দ্রুত সম্ভব ড্যাপের গেজেট করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সভাপতি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। তিনি বলেন, আজকে মন্ত্রীকে ধন্যবাদ এ জন্য যে, ড্যাপকে একটি সেমিনার পর্যায়ে আনতে পেরেছেন।

তিনি ড্যাপ নিয়ে যেসব অংশীজন কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের কাউকে মানা করেননি। আমি মনে করি যত দ্রুত সম্ভব ড্যাপের গেজেট করা উচিত। ২০১৬-৩৫ সালের জন্য নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নিয়ে শনিবার (২০ নভেম্বর) রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত সেমিনারে এসব কথা বলেন আহমেদ আকবর সোবহান।

 

বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ২০১০ সালের ড্যাপ দেখে মনে হয়েছিল, বেসরকারি খাতকে একবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। তখন যিনি পূর্তমন্ত্রী ছিলেন, তার একটাই উদ্দেশ্যে ছিল বেসরকারি খাত বলতে কোনো জিনিস থাকবে না। সবকিছু করবে সরকার। তখন সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন রিহ্যাবের সভাপতিসহ আমরা প্রতিবাদ করলাম। আমার সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদ অনেক কিছু হলো। পরে এ নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি হলো। তখনকার এক প্রখ্যাত প্রকৌশলী, বাংলাদেশের গর্ব ছিলেন, তিনি নিজেও স্বীকার করলেন ওই ড্যাপে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। ড্যাপে অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে। সেই ভুল ত্রুটি নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে। গেজেট করতে হবে এবং সেটাই সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই শুধু রাজউক, সরকারি খাতই ল্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট বা আবাসন যাই বলেন, সবই করবে রাজউক ও সরকার।

 

আহমেদ আকবর সোবহান আরো বলেন, তখন রিহ্যাবের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেখানে সবাই বললেন যে ড্যাপ হচ্ছে, তা তো দেশকে ধ্বংস করে দেবে। তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি ড্যাপ রিভিউ কমিটি করে দিয়েছি। তখন তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী রিভিউ কমিটি গঠন করেছিলেন সাতজন মন্ত্রী, ২১ জন সচিবকে নিয়ে। সেই রিভিউ কমিটি ড্যাপ পর্যালোচনা করে, যারা শুদ্ধ তাদের নতুন করে অনুমোদন দেওয়ার কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল না থাকলে আজকে আবাসন খাতের ঢাকার দুই হাজারসহ সারাদেশের ২০ হাজার ডেভেলপার নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। প্রধানমন্ত্রী শুধু একজন রাজনীতিবিদ না। তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বড় প্ল্যানার। তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দূরে দেখেন। আমরা যেটি আজ ভাবি, তিনি তা আগামীকালের জন্য চিন্তা করেন। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী যদি এই দূরদর্শী ভূমিকা না নিতেন, আজকে হয়তো বাংলাদেশ এই পর্যায়ে আসত না।

বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, আপনারা নিশ্চিয়ই জানেন জিডিপিতে আবাসন খাতের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ অবদান আছে। এই খাতের সঙ্গে ৪৭১টি খাতে ২০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান জড়িত। অন্ততপক্ষে এক কোটি লোক আবাসন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আজকে সত্যি কথাটা বলতে হয় অনেকে হয়তো জানেন না। বলা যায়, সেদিন ড্যাপ ফাইনাল হয়েছিল একটি পত্রিকা অফিসে। সেদিন যদি আমরা ড্যাপ গ্রহণ করতাম, তাহলে সেদিন থেকেই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ওত পেতে ছিল। সেদিন আমরা বাধা না দিলে আজকে দেশের অন্য রূপ হতো। সেদিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আমাদের পরিবেশ দরকার। আবাসন খাতে সবাই শিক্ষিত। এখানে এমন কোনো লোক নেই, যারা পরিবেশ ধ্বংস করে দেশের উন্নয়ন করবেন। পরিবেশ না থাকলে আমরা কেউ বাঁচব না। আজকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী কয়লায়চালিত প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছেন। পরিবেশ নিয়ে আমরা সবাই সচেতন। পরিবেশ না বাঁচলে আমরা কেউ বাঁচব না। আজকে আমারিকা সবচেয়ে বেশি পরিবেশবাদী। সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণকারীও তারা। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা পরিবেশ ঠিক রাখব। এ ব্যাপারে সবাইকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে এবং পরিবেশ ঠিক রেখেই উন্নয়ন করতে হবে।

 

আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, আজকে মন্ত্রীকে ধন্যবাদ এ জন্য যে, ড্যাপকে একটি সেমিনার পর্যায়ে আনতে পেরেছেন। তিনি ড্যাপ নিয়ে যেসব অংশীজন কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের কাউকে মানা করেননি। আমি মনে করি যত দ্রুত সম্ভব ড্যাপের গেজেট করা উচিত। রিহ্যাবের যারা ডেভেলপার তারা হাজার হাজার চুক্তি করে রেখেছেন। কিন্তু তারা কোথাও ডেভেলপমেন্ট করতে পারছেন না। ঢাকায় ৫০ হাজার প্ল্যান পাস হচ্ছে না ড্যাপের কারণে। এই ড্যাপ নিশ্চয়ই এমন কোনো জিনিস না যে, এটা পরিবর্তন হবে না। নিশ্চয়ই ড্যাপের রিভিউ কমিটি থাকবে। যাদের যেখানে অসুবিধা হবে, সমন্বয় হবে। কিন্তু আমার মনে হয় এটাই সময়। এখন গেজেট না হলে আর কোনোদিনই সম্ভব হবে না।

 

তিনি বলেন, সবাই নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, সবাই পরিবেশসম্মত ভবন করবেন। পাশে খেলার মাঠ থাকবে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। ঢাকা শহরে ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র একটি বাদে ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। আমি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ করব, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি খেলার মাঠ থাকতে হবে। এটা না হলে মানুষের বিকাশ হবে কীভাবে? এসব ব্যাপারে রাজউক আরো আন্তরিক হবে আশা করছি।

আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, এবারের অনেক সুন্দরভাবে রাজউকের প্রকল্প পরিচালক ড্যাপ করেছেন। মানুষের ঘরে ঘরে, বাড়িতে বাড়িতে গেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়েছেন। কিন্তু এটা সত্যি কথা যে, বাস্তবায়ন করা এত সহজ হবে না, যদি আমরা সবাই মিলে রাজউক ও পূর্ত মন্ত্রণালয়কে সাহায্য না করি। ঢাকা শহরে দুটো সুন্দর রাস্তার একটি মাদানি এভিনিউ, আরেকটি তিন শ ফুট। কিন্তু কোনো রক্ষাণাবেক্ষণ নেই। এ দুটি রাস্তা ঢাকা শহরের গর্ব করার মতো বলা যায়। অথচ কোনো রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় রাতের বেলায় সব ট্রাক-বাসের গ্যারেজ হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, আগের ড্যাপের গেজেটে যেসব হাউজিং প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল, সেসব যেন ঠিক থাকে। কিছু জিনিস আমার দুঃখ লাগে যে, প্রেসিডেন্ট গেজেট করে দিয়েছেন, তার ওপরে দেখি রাজউকের বেশ কিছু অফিসার হাত বোলান। প্রেসিডেন্ট যেখানে সই করেছেন, সেখানে রাজউকের একটা ক্লার্ক বলেন, এই গেজেট মানি না। তাহলে কোথায় আমরা আছি!

তিনি বলেন, রাজউককে অবশ্যই ডিজিটালাইজড করতে হবে। প্ল্যানের ব্যাপারে সময় নির্ধারণ করতে হবে। মানুষের ভোগান্তিুও কমাতে হবে। রাজউকের ভোগান্তির ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজউককে গতিশীল করতে হবে। যারা ডেভেলপার আছেন, তারা সহজভাবে যেন প্ল্যান পান, সে বিষয়টি রাজউক ও পূর্ত মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করতে হবে। রাজউকের চেয়ারম্যান দেওয়া হোক কমপক্ষে তিন বছরের জন্য।

বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন হলো- রাজউকে একজন চেয়ারম্যান এসে কাজ শুরু করেন। কদিন পর তিনি সচিব হয়ে চলে যান। এখানে এমন একজনের চেয়ারম্যান হওয়া উচিত, যিনি কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ বছর কাজ করতে পারবেন। এভাবে ২, ৩, ৪ মাস পরে চলে গেলে কারো রাজউকের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে না। রাজউকে ঢোকার পর ছয় মাস লাগবে বুঝতে। কিন্তু বোঝার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যান সচিব হয়ে চলে গেলে তারা কাজ করার সময় পান না। ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হলে কমপক্ষে তিন থেকে চার বছরের জন্য একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিন।

তিনি আরো বলেন, করোনায় ১০ লাখ লোক কাজ হারিয়েছেন। এখন একমাত্র আবাসন খাত, যেখানে কর্মসংস্থান সম্ভব। সারাদেশে কিন্তু প্রতিটি অলি-গলিতে মানুষ উন্নয়ন করছেন এবং সেই সুযোগটা দিন। দেশ, জাতি ও বিনিয়োগের জন্য ড্যাপ জরুরি। সময়ক্ষেপণ না করে যত শিগগিরই সম্ভব ড্যাপের প্রস্তাবনা আকারে অনুমোদন দিন। আমার মনে হয়, এটা রিভিউ করা সম্ভব। রিভিউ কমিটি নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যাবে না।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি বলেন, ড্যাপের চ্যালেঞ্জ হলো বাস্তবায়নে। আশা করি, ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারব। রাজধানীকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। রাজউকের বিরুদ্ধে আমরা অনেক অভিযোগ পাই। রাজউককে দ্রুত ডিজিটালাইজ করা দরকার। রাজউক চাইলে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, উন্নত শহর গড়ার সব উপাদান নিয়ে ড্যাপ করা হয়েছে। তাই সবাই মিলে কাজ করলে ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব। এফবিসিসিআই সব অংশীজনদের নিয়ে ড্যাপ বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণ করবে। বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়নে সরকারকে এগুতে হবে। এবারের ড্যাপ যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়, এফবিসিসিআই সেই উদ্যোগ নেবে।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বলেন, ড্যাপের সঙ্গে বাংলাদেশের যার এক ইঞ্চি জমি আছে, তারও ভাগ্য জড়িত। ড্যাপের দুই হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্টস পড়ে বুঝতে সময় লাগবে। কারণ, এবারের ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হলে, ঢাকা থেকে ৫০ লাখ লোক বের করে দিতে হবে। এর মধ্যে ড্যাপের বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে। ২০৩৫ সাল নাকি ৪০ সালে ড্যাপের বাস্তবায়ন হবে, আমি তা নিয়ে সন্দিহান। ৫৩ সংস্থার সম্মিলিত সমন্বয় ছাড়া ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব না। এর আগে ড্যাপ দিয়ে বেসরকারি খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এখন ড্যাপ জনগণকে কী বার্তা দেবে, সেটাও সরকারকে ভাবতে হবে। আমি এটুকু বলতে পারি- ড্যাপে ডেভেলপাররা ধ্বংসের মুখে পড়বেন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ইকবাল হাবীব, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ, ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সিইও সেলিম রেজা, ডিপিডিসির গিয়াসউদ্দিন জোয়াদ্দার, বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by