রাজশাহী

নাটোরে প্রাকৃতিক জলাধার ও পুকুর ভরাট পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা

  প্রতিনিধি ১৭ এপ্রিল ২০২৩ , ৫:১৯:০৮ প্রিন্ট সংস্করণ

এস এম কামাল হোসেন, নাটোর :

জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর ৩৬ ধারা অনুযায়ী কোনো পুকুর, জলাশয়, খাল ও লেক ভরাট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও তা নিষিদ্ধ। এসব আইন থাকা সত্তে¡ও অভিযোগ উঠেছে, নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের প্রাকৃতিক জলাশয়, খাল, নয়নজুলি এবং নাটোর পৌর পুকুর ভরাট করে পানির উৎস ও প্রবাহ বন্ধ করা হচ্ছে। নাটোর সড়ক বিভাগ থেকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও ব্যক্তিকে পত্র দিয়েও কোন প্রতিকার হচ্ছে না। এসব ভরাট কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে আবাদি জমির মাটি ও বালি। প্রশাসনের নাকের ডগায় ভরাট করে গড়ে উঠছে স্থাপনা। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের দাপটে কেউ মুখ খুলতে পারছেন না বলে অভিযোগ সচেতন মহলের। স্থানীয় প্রশাসন দায় সারা অভিযান পরিচালনা করে বন্ধ করলেও তা বন্ধ থাকছে না। এতে মৎস্যসম্পদের ক্ষতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়া (জাহাঙ্গীরাবাদ) নাটোর জাতীয় মহাসড়কের ছোট হরিশপুর, সড়কের উভয় পাশে, নাটোর সদর উপজেলার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে (মহাসড়ক সংলগ্ন) থেকে শুরু করে ভাটো দারা, উত্তারা গণভবনের প্রবেশ পথ বঙ্গবন্ধু মোড়ালের পার্শ্বস্থ জলাধার, ডাল সড়ক নামক স্থানে খাল, সিংড়া উজেলার খেজুরতলা ও আমতলায় পুকুর এবং জলাশয়, বন্দরে প্রাকৃতিক জলাধার, সেরকোল কফিলের ব্রিজের নিচু মরাগাঙ্গীনা নদী এবং খাল অবাদে চলছে ভরাট। কেউ কেউ পাকা স্থাপনা তৈরি করে মার্কেট, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করছেন। আবার মরাগাঙ্গীনায় পানি প্রবাহ বন্ধ বাঁধ দিয়ে মাছ আর ধান চাষ করছেন এ নদীতে।
এছারাও নাটোর পৌর এলাকার মধ্যে কালেক্টোর স্কুলের সামনে আজাদের পুকুর, হরিশপুর চেয়ারম্যান রোডে সাবেক কাউন্সিলর ফারহাদ হোসেন এর ভাগ্নী জামাই ও তার পাটনার টিটু এবং তেবাড়িয়া উত্তর পাড়া, পাল পাড়া, লালবাজার, চৌকির পাড়, কাঠালবাড়িয়াসহ পৌরসভার বিভিন্ন পুকুর এবং প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট হচ্ছে। সড়ক বিভাগের তথ্যমতে জানা যায়, নাটোর সড়ক বিভাগের বগুড়া (জাহাঙ্গীরাবাদ) নাটোর (এন ৫০২) জাতীয় মহাসড়কের চেইনেজ ৫২ প্লাস ৬ শ কি.মি. এর বন্দর নামক স্থানে নাটোরে শহরের উত্তর বড়গাছা মহল্লার সিরাজুল ইসলামের ছেলে শফিকুল ইসলাম সড়ক পার্শ্বস্থ সওজের জমিতে প্রাকৃতিক জলাধার অবৈধভাবে ভরাট করছেন। বিষয়টি সড়ক বিভাগের নজরে আসলে গত বছরের ২৯ এপ্রিল সিংড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কে সরকারি সম্পদ রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নাটোর সড়ক বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী তন্ময় চক্রবর্তী পত্র প্রেরণ করেছেন।
স্থানীয় কৃষক ও আ.লীগ নেতা রাজ্জাক বলেন, আতাইকুলা মৌজার রাশিদুন বেগম ও নাজিরের ৫৬ শতক এবং কালামের ১০ শতক কৃষি জমি বন্দর আমতলা থেকে প্রায় দের বছর পূর্বে ক্রয় করেন, নাটোর শহরের শফিকুল ইসলাম। এরপর সড়র বিভাগ থেকে লীজ নিয়েছেন বলে ওই জায়গা ভরাট এবং দখল শুরু করেন শফিকুল। এভাবে খাল-জলাশয় ভরাট হলে আমরা কৃষক আবাদ করবো কিভাবে নদীতে পানি নাই, টিউওলে পানি নাই। জমিতে সেচ দিতে পারছি না ।
নাটোর কালেক্টোর স্কুলের অধ্যক্ষ জিএম ইস্রাফিল ইসলাম ও অভিবাবক সাইফুল ইসলাম জানান, কালেক্টোর স্কুলের সামনে দিয়ে পানি নিষ্কাশনের জায়গা ভরাট করে ভবন তৈরি করছেন। তার পাশের পুকুর ভরাট করে প্ল্যান অনুমোদন নিচ্ছেন এসব অভিযোগ করেও পৌর কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেননি। অভিযোগ খন্ডনের জন্য পৌর সভায় ডেকে সময় নষ্ট করে ফিরে আসছি, মেয়র না থাকায় শুনানী হয়নি। পরে দেখছি ভবন নির্মাণ চলছে।
প্রধানমন্ত্রীর জারি আদেশ, ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা এক আদেশে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জনগণের আশ্রয়স্থল রক্ষা ও অগ্নিনির্বাপণে সহায়তা করতে কোনো অবস্থায় খাল-বিল, পুকুর-নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করা যাবে না এবং এর গতিপথ পরিবর্তন করা যাবে না। তবে কোনো দফতর যদি সরকারি কাজে নিজস্ব পুকুর ভরাট করতে চায়, সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পুকুর ভরাটের একটি প্রস্তাব পাঠাতে হবে। চাইলেই পুকুর ভরাট করা যাবে না। ব্যক্তি মালিকানাধীন হিসেবে রেকর্ড করা পুকুরগুলো জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর ২ (চ) ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত মামলার রায় পাওয়ার এক বছরের মধ্যে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সচিবকে এ আদেশটি বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানার পুকুর ভরাট করা নিয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০২০ সালের ৫ মার্চ ওই রায় দেন। আইনের ২ (চ) ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের আওতায় মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহর, পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার মাস্টারপ্ল্যানে চিহ্নিত নদী, খাল, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাশয় সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে ঘোষিত প্রাকৃতিক জলাধারের আওতায় আনা হয়েছে।
নাটোর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র ষ্টেশন অফিসার আক্তার হামিদ খান জানান, গত ১ বছরে নাটোর শহরে ৫৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। শহরের ভেতরে বা বাইরে পানি সংরক্ষণের জায়গাগুলো ভরাট বা বন্ধ না করাই উত্তম; বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডের সময় পুকুর বা খাল, প্রাকৃতিক জলাধার এসব স্থান থেকে পানি নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট করলে মৎস্য আহরণে ভাটা পড়ে। এতে শুধু মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয় না, বাড়িতে আগুন লাগলেও পানির সংকট হয়। পুকুর ভরাট চলতে থাকলে মৎস্য আহরণ কমে যাবে। চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
এব্যপারে সিংড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল- ইমরান বলেন, জলাধার ভরাট হচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক তার সার্ভেয়ার ও তহশীলদারকে নিয়ে গত রোববার বন্দর আমতলা নামক স্থানে অভিযান করে ওই কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। যেহেতু সড়ক বিভাগের জায়গা তার জন্য পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাদের জানানো হয়েছে।
নাটোর সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল মান্নাফ আকান্দ বলছেন, মহাসড়কের পার্শ্বে লীজ দেওয়ার কোন সুযোগ নাই এমন কি ব্যক্তিগত জায়গা হলেও মহাসড়ক থেকে ৩০ ফিট দূরে স্থাপনা করতে হবে আইনে সেটাই আছে। এছারাও অবৈধ/অনুমোহীনভাবে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও সড়কের পাশে জলাধার ভরাট বন্ধের জন্য বিভাগীয় অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও অবৈধ দখলদার ব্যক্তিকে অবগত করার জন্য গত ১১-০৪-২৩ ইং চিঠি দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি জানান, পুকুর খনন এবং বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নাই। তবে পৌর এলাকার মধ্যে হলে অনুমতি লাগে। রাষ্টের প্রচলিল আইন ও পৌর আইন যদি কেউ অমান্য করে তাহলে ইউএনও এবং এ্যাসিল্যান্ড এর সহায়তায় প্রদক্ষেপ নেয়া হবে।

Powered by