আন্তর্জাতিক

রোহিঙ্গাদের হত্যা করে এখন তাদেরই সহায়তা চায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী

  প্রতিনিধি ৮ এপ্রিল ২০২৪ , ৪:৪৫:২৬ প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গাদের হত্যা করে এখন তাদেরই সহায়তা চায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় সাত বছর ধরে হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের হত্যা করে এখন রোহিঙ্গাদেরই সাহায্য চাইছে আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আজ সোমবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসির সাংবাদিকরা জানতে পেরেছেন, জান্তা বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অন্তত ১০০ জন রোহিঙ্গাকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

বিবিসি এমন সাতজন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের আসল নাম প্রকাশ করেনি বিবিসি। মোহাম্মদ (ছদ্মনাম) নামের এক রোহিঙ্গা বিবিসিকে বলেন, ‘আমি ভীত ছিলাম, কিন্তু আমাকে যেতে হয়েছিল।’ তিনি রাখাইনের রাজধানী সিত্তওয়ের কাছে বাও দু ফা ক্যাম্পে থাকেন। গত এক দশক ধরে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা আইডিপি ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হয়েছে।

তিন সন্তানের জনক ৩১ বছর বয়সী মোহাম্মদ জানান, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ক্যাম্পের নেতা গভীর রাতে আমার কাছে আসেন। তিনি বলেছিলেন, আমাকে সামরিক প্রশিক্ষণে যেতে হবে, এটি সেনাবাহিনীর আদেশ। আদেশ না মানলে আমার পরিবারের ক্ষতি করা হবে বলে তারা হুমকি দিয়েছিল।

মোহাম্মদের মতো রোহিঙ্গা পুরুষদের জন্য চরম পরিহাসের বিষয় হলো, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এখনো নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত। আর নিজস্ব সম্প্রদায়ের বাইরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার মতো বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধের একটি ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার তারা।

২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যের মিশ্র সম্প্রদায় থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। আর তাদেরকে নির্ধারিত এসব শিবিরে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল। পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের আগস্টে, সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নৃশংস জাতিগত নিধন অপারেশন শুরু করে। সেই নিধন অপারেশনে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল। ধর্ষণ করা হয় তাদের নারীদের। এছাড়াও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের গ্রাম। ওই সময় অন্তত ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তা সত্ত্বেও, এখনো প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে টিকে আছে।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলার কার্যক্রম এখনো চলছে।

সম্প্রতি আরাকান আর্মি নামের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে রাখাইন অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূখণ্ডের দখল হারানোর পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে।

রোহিঙ্গাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টার উদাহরণ- এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।

দেশের অন্যান্য অংশেও ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশটির সামরিক জান্তা। শনিবার পূর্বাঞ্চলে থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ শহর মায়াবতীর দখল হারিয়েছে জান্তা। বাণিজ্যিককেন্দ্র হিসেবে এই স্থলবন্দরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক সংঘর্ষগুলোতে সামরিক জান্তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সেনাও হারিয়েছে। বিরোধী পক্ষের হাতে তারা নিহত, আহত হয়েছেন এবং কেউ কেউ আত্মসমর্পণ বা এমনকি, বিরোধী পক্ষেও যোগ দিয়েছেন। যার ফলে নতুন সেনা খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে জান্তা।

পরিস্থিতি এমনই যে মিয়ানমারে এখন খুব কম লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা দেশটির অজনপ্রিয় জান্তা সরকারের জন্য নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিতে আগ্রহী।

রোহিঙ্গাদের আশঙ্কা, এ কারণেই তাদের আবার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। যে যুদ্ধে জান্তা হেরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, সেই যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের বলি বানানো হচ্ছে।

মোহাম্মদ জানান, তাকে সিত্তওয়ের ২৭০তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় বসতি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের এই শহরে (সিত্তওয়ে) বসবাস নিষিদ্ধ করা হয়।

মোহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের শেখানো হয়েছিল কীভাবে বুলেট লোড করতে হয় এবং গুলি করতে হয়। এছাড়াও তারা আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে একটি বন্দুককে বিচ্ছিন্ন করা এবং পুনরায় একত্রিত করা যায়।’

বিবিসি’র দেখা একটি ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের অন্য একটি দলকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত একটি পুরানো স্ট্যান্ডার্ড অস্ত্র বিএ-৬৩ রাইফেল কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা শেখানো হচ্ছে।

মোহাম্মদকে দু’সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তারপর তাকে বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মাত্র দু’দিন পর তাকে আবার ডাকা হয়। আর ২৫০ জন সৈন্যের সাথে একটি নৌকায় চড়ে পাঁচ ঘণ্টা নদীতে রাথেদাউং পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখানে তিনটি সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণের জন্য আরাকান সেনাবাহিনীর সাথে বিরোধী বাহিনীর একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছিল।

তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম না কেন আমি যুদ্ধ করছি। যখন তারা আমাকে একটি রাখাইন গ্রামে গুলি করতে বলে, তখন আমাকে গুলি করতে হয়।’ 

রাখাইনে ১১ দিন যুদ্ধ করেন মোহাম্মদ। এই সময়ে তিনি সেনাবাহিনীতে জোর করে নিযুক্ত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে গোলার আঘাতে নিহত হতে দেখেছেন। যুদ্ধে মোহাম্মদ নিজেও আহত হন। তার উভয় পায়ে গোলা বা গুলির টুকরার আঘাত লাগে। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য সিত্তওয়েতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

মোহাম্মদ বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। মনে হচ্ছিল মায়ের গর্ভ থেকে আবার জন্ম নিচ্ছি।’

এদিকে, রোহিঙ্গাদের জান্তা বাহিনীতে যোগদানের নির্দেশের বিষয়টি অস্বীকার করছে জান্তা সরকার। জান্তার মুখপাত্র জেনারেল জাও মিন তুন বিবিসিকে বলেন, ‘তাদের সামনের সারিতে পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। তাই তাদের নিজেদের প্রতিরক্ষা যাতে নিজেরাই করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চাইছি।’ 

মোহাম্মদকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, যেখানে তিনি তাদের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। তবে মোহাম্মদের কোনো ধারণা নেই যে, এর মূল্য কি, বা এটি তাকে সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় কিনা। তার মতে, আরাকান আর্মি যদি সিত্তওয়ে এবং তার শিবিরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তাহলে এই সার্টিফিটেক তাকে সমস্যায় ফেলতে পারে।

মোহম্মদ ধীরে ধীরে আঘাত থেকে সেরে উঠছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি তারা আমাকে আবার ফোন করবে। এবার আমি ফিরে এসেছি কারণ আমি ভাগ্যবান ছিলাম, কিন্তু পরের বার কী হবে তা আমি নিশ্চিত নই।’

আরও খবর

Sponsered content

Powered by