ঢাকা

‘অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকরা চিৎকার করলেও বলা হয় ভেতরে থাকতে’

  প্রতিনিধি ১০ জুলাই ২০২১ , ৫:৩৭:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্কঃ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার ভবনের নিচতলা থেকে প্রতিটি ফ্লোরই আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। আগুন লাগার পর দোতলা, তিনতলা থেকে কারখানার কর্মীরা বেরিয়ে আসেন। পাঁচতলা ও ছয়তলার কর্মীরা ছাদে চলে যান।  চারতলার সিঁড়িতে তালাবদ্ধ থাকায় কর্মীরা আটকা পড়েন। তারা নিচেও নামতে পারেননি আবার ছাদেও যেতে পারেননি।

শনিবার (১০ জুলাই) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কারখানাটি সরেজমিনে ঘুরে, কারখানার জীবিত শ্রমিক ও আশপাশের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের সিঁড়ি ও গ্রিল আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জানালার গ্রিল ও সিঁড়ির গ্রিলের প্রতিটি শিক বেঁকে গেছে। ছাদ থেকে খুলে পড়ছে পলেস্তার।

 

ইমরান আহমেদ নামের একজন পাঁচতলায় জুস তৈরির কাজ করতেন। তিনি জানান, চারতলায় তার পূর্বপরিচিত ফাহিম নামের একজন কাজ করতেন। আগুন লাগার সময় ফাহিম ইমরানকে ফোনে জানান, চারতলা থেকে নিচে নামার গেটটি তালা দেয়া। আবার ছাদে ওঠার সিঁড়িতেও তালা দেয়া। চারতলায় ৫০ জনের বেশি কর্মী কাজ করছে। এ অবস্থায় তারা আটকে পড়ে।

ইমরান বলেন, পাঁচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চারতলায় গিয়ে দেখি গ্রিলে তালা দেয়া। এরপর অনেকের ফোন দিলেও কেউ তালা খুলতে আসেনি।

শিউলি খাতুন কাজ করতেন তিনতলায়। তিনি বলেন, ‘নিচে আগুন লাগার খবর শুনে সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়া করে নামতে নামতে অনেকেই সিঁড়িতে পড়ে যান। ভাগ্যক্রমে আমি নিচে নেমে আসি। কিন্তু আাঁর আপন বোন হাসি আক্তার চারতলায় কাজ করতেন। তার খোঁজ এখনো পাইনি।’

 

শিউলি বলেন, ‘শুনেছি চারতলায় তালা দেয়া ছিল। এ কারণে কেউ বের হতে পারেনি। ঢাকা মেডিকেলে খোঁজ নিয়েছি। ডিএনএ নমুনাও দিয়েছি। কিন্তু এখনো বোনের কোনো হদিস পাইনি।’

হাসেম ফুডস লিমিটেডের চকলেট লাইনের অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন হাবিবুল বাশার। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার পাশের ভবনের চারতলায় ডিউটিতে ছিলেন তিনি। আগুন লাগার পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে দেখেন নিচতলায় ধোঁয়া। এরপর ধীরে ধীরে আগুন ওপরের দিকে উঠতে থাকে। অনেকে লাফিয়ে পড়ছিলেন। কেউ আবার ভেতরে আটকা পড়ে চিৎকার করতে থাকেন। ভেতর থেকে প্রতিষ্ঠানের কেউ তখনো বলছিলেন, বড় কিছু হবে না। ভেতরে সবাইকে একসঙ্গে থাকার জন্য বলতে থাকেন।

হাবিব জানান, কারখানাটিতে অনেকে কাজ করেন, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। বয়স যাদের কম, তাদের হালকা কাজ দেয়া হয়।

শ্রমিক তাজুল ইসলাম জানান, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে স্টোররুম থেকে কিছু মালপত্র আনতে গিয়ে তিনি নিচ থেকে শ্রমিকদের চিৎকার শুনতে পান। সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া দেখতে পান। ধোঁয়া আর আগুনের তাপ এতটা ছিল যে, নিচে নামার সুযোগ পাননি। পরে বাধ্য হয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলার ছাদের ওপর পানির ট্যাঙ্কির কাছে চলে যান। সেখানে তার মতো আরও ১৩-১৪ জন শ্রমিক আশ্রয় নেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে দড়ি দিলে তারা নিচে নেমে আসেন।

 

ছাদ থেকে নেমে আসা আরেক শ্রমিক জাকির হোসেন বলেন, আগুন লাগার পর প্রচুর ধোঁয়া এবং তাপের কারণে নিচের দিকে নামতে পারছিলাম না। পরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাই। জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। পরে দড়ি বেয়ে অন্য শ্রমিকদের মতো নিচে নেমে আসি।

ভবনে ছিল না অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা-এক্সিট ওয়ে
কারখানার ভবনটিতে আগুন নেভানোর কোনো সরঞ্জাম ছিল না। ছিল না জরুরি বের হওয়ার প্রয়োজনীয় সংখ্যক পথও।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন্স লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, অধিকাংশ মরদেহ চারতলার জানালার পাশে পাওয়া যায়। এতটাই অঙ্গার হয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া পরিচয় শনাক্ত করা অসম্ভব। হয়তো প্রাণে বাঁচতে সবাই জানালার পাশে অবস্থান করছিলেন।

জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ভবনটির আয়তন প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট। ওই ভবনের জন্য অন্তত চার থেকে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা দরকার ছিল। অথচ বড় এ ভবনে আমরা পেলাম মাত্র দু’টি সিঁড়ি। আগুন লাগার পরপরই একটি সিঁড়ি ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। শুরুতেই সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেউ যেতে পারেননি। দ্বিতীয় সিঁড়ির কাছেও তাপ ও ধোঁয়ার কারণে ভেতরে আটকে থাকা শ্রমিকরা যেতে পারেননি।

 

অগ্নিকাণ্ডে হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৮
অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহাণিতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

শনিবার (১০ জুলাই) দুপুরে কারখানাটি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সারাদেশ এ ঘটনায় স্তব্ধ। একসঙ্গে এতজনের প্রাণহানি খুবই দুঃখজনক। প্রথমে তিনজন পরবর্তীতে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। ফায়ার সার্ভিস কিছু জীবিতদেরও উদ্ধার করেছে। এখন পর্যন্ত আটজনকে আটক করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কারখানায় কতজন লোক কাজ করত, সবই তদন্তে বেরিয়ে আসবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি সহযোগিতা করা হয়েছে। আরও সহযোগিতা প্রয়োজন হলে সরকারের পক্ষ থেকে করা হবে।

মামলা ও দোষীদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই মামলা হবে, এর সঙ্গে সামান্যতম দোষীদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। তদন্তের আগে বিস্তারিত কিছু বলতে চাচ্ছি না। তদন্ত শেষে অবশ্যই তাদের বিচার হবে।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by