প্রতিনিধি ৬ জুন ২০২০ , ৭:৫৩:০৪ প্রিন্ট সংস্করণ
উত্তম ঘোষ, যশোর : ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবের ১৫দিন পার হলেও জেলায় বিভিন্ন এলাকায় বহু মানুষ এখনো স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারেননি। ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ায় এখনো আশ্রয়হীন কয়েক হাজার মানুষ। এখনও বিদ্যুৎহীন বহু এলাকা। ফলে নেই মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তা–বে গাছ উপড়ে পড়ে যশোরে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ।
আম্পানের তা–বে ৫ লক্ষ ৭৮ হাজার ২১৭ জন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ফসলহানি হয়েছে ১৫ হাজার ২৩৪ হেক্টর, পাকা ও কাচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৩৩ কিলোমিটার, ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ৫শ’ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার মণিরামপুর, শার্শা, অভয়নগর, কেশবপুর ও চৌগাছায় উপজেলায়। জেলায় ঘূর্ণিঝড় অম্পানে ফসল, গবাদিপশু, মৎস্য, বসতভিটা ও সড়কসহ বিভিন্ন খাতে ক্ষতি হয়েছে দুই শ’ ৮৩ কোটি টাকার ওপরে বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। তবে এই বিপুল ক্ষতির বোঝা সামলে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে এসব ক্ষতিগ্রস্থরা তা বুঝে উঠতে পারছেন না।
জেলা ত্রাণ ও পূর্ণবাসন অফিসমতে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ভেঙে ও উপড়ে গেছে গাছপালা। এছাড়া মাটির সঙ্গে মিশে গেছে কৃষি পণ্য। আর এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। মারাত্মক এ ক্ষতির পরিমাণ দুই শ’৮৩ কোটি ৩০ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষিখাতে। যশোরের আট উপজেলায় সম্পূর্ণ শষ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৫ হাজার হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৯ হাজার ৮শ’ ৬১ হেক্টর। বীজতলা ক্ষতি হয়েছে ৬৪ হেক্টর। এ ছাড়া শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতিও অনেক। যা মোট ক্ষতি হয়েছে ১৩২ কোটি ১২ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকা। আম্পানে জেলায় ১৩২ হেক্টর মাছের পুকুর ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মৎস্য ২ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রায় দুই দিন ধরে চলা আম্পানের ঝড়ের তান্ডবে বিদ্যুৎ বিভাগের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। যার কারণে প্রায় অর্ধমাস দিনরাত কাজ করেও জেলায় বিভিন্ন জায়গায় এখনো বিদ্যুৎ পৌচ্ছেতে পারেনি। জেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতি ১৪.৫ কিলোমিটার ও আংশিক ১৫৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎতের লাইন। যা ক্ষতি হয়েছে ২১ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকা।
আম্পানের ঝড়ে কৃষিখাতের পর আশ্রয়হীন হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। কাঁচা, আধাপাকা, পাকাবাড়ি ৮৮ হাজার ৩১৪টি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যা মোট ক্ষতি হয়েছে পাকাবাড়ি ৯৭ লক্ষ, আধাপাকা ৬০ কোটি ৬৭ লক্ষ, কাাঁচাবাড়ি ৮১ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। জেলায় প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৩৯টি এবং ক্ষতি হয়েছে ৯ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা, উচ্চ বিদ্যালয় ১৫৯ টি বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যা ১৩ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। মাদ্রাসা ৭৬টি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৭৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে হস্তচালিত, গভীর ও অগভীর নলকুপের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জেলায় ৫৫০টি গভীর নলকুপে ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা। জেলায় অগভীর নলকুপ ১ হাজার ২২০টি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যা ৯৮ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। হস্তচালিত নলকুপ ২৫টি ৬ লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের ১৫টি মোবাইল টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যা ক্ষতি হয়েছে ১৩ লক্ষ টাকা। ৩৮৪টি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যা ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ৯শ’৬৬ টি মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা ১৯ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩০টি গীর্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা ৮৫ হাজার ক্ষতি হয়েছে। যশোর জেলায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব রাস্তা কোথাও পুনঃসংস্কার আবার কোথাও নতুনভাবে করতে হবে। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৮ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ১১ টি ব্রিজ কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা ক্ষতির পরিমাণ ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। ৬ হাজার ৭শ’ ৯৭টি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ১ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক টয়লেট, বিভিন্ন পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা। ১টি ক্লিনিক ও ৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ক্ষতি হয়েছে ৪ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বারাকপুর গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত। কৃষিতেই তার জীবন জীবিকা। ঘুর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়েছে তার জীবিকা। তার ক্ষেতের দুই বিঘা পেঁপে, এক বিঘা করলা (উচ্ছে), ২৫ কাঠা জমির তিল ও দুই বিঘা জমির পাট ক্ষতিগ্রস্থ। ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষকরা। এবার ভয়ঙ্কর ঝড় হয়েছে। আমার সব শেষ করে দিয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবো কি করে ভাবতে পারছি না। এমন ভয়ঙ্কও ঝড় ১৯৮৮ সালের ঝড়কেও হার মানিয়েছে। এমন মার কখনো খায়নি।
অপর কৃষক যশোর সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের হারুন অর রশিদ বলেন, সাড়ে তিন বিঘা জমির লিচুর সব ধুলিসাৎ করে দিয়েছে ঝড়ে। সঙ্গে লাউ, উচ্ছের মাচাও উলোটপালট করেছে। লিচুতেই আট লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। লাউ ও উচ্ছের মাচা নষ্ট হয়ে গেছে। মাচা আবার মেরামত করছি। লিচুর ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা কঠিন হবে। এসব ক্ষতি থেকে কৃষকদের কাঁটিতে তুলতে সরকারের সাহয্য কামনা করেছেন তিনি।
চৌগাছার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা হারুন কবীর রুবেল বলেন, ১২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে কলা পেঁপে ও পেয়ারা চাষ করেছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ে কলা ও পেঁপের ক্ষেত সব নষ্ট হয়েছে। আশা করেছিলেন ১০ লাখের উপরে লাভবান হবেন তিনি। এখন উল্টো দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এতে প্রায় ৭ লাখ টাকার ক্ষতি হলো। উঠতি ফসলে বড় ধরণের মার খেয়ে গেলাম আমরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বোরো ধানের তেমন ক্ষতি হয়নি। কিছু ধানের বীজতলা ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। কাজ শেষে ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। সরকারি সহায়তা পেলে তালিকায় অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কৃষকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে।
মৎস্য অধিদপ্তর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, যশোর জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হ্যাচারি ও চাষীদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাহয্য করা হবে।
এ সব ব্যাপারে যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির– ২ জেনারেল ম্যানেজার অরুণ কুমার কুন্ড বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে ৩০২ টি বৈদ্যুতিক পেটাল ভেঙ্গে যায়। বৈদ্যুতিক লাইনের পিলারের তার ছিড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। দিন রাত তার কর্মীরা ছুটে চলছেন ভেঙ্গে পড়া বিদ্যুৎতের মেরামতের কাজে। এখনো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় বিদ্যুৎ যায়নি জানতে চাইলে বলেন, সব গ্রাহকই দ্রুত বিদ্যুৎ পেয়ে যাবেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন জানান, আম্পানের আঘাতে যশোরের ৮টি উপজেলার ৯৩টি ইউনিয়ন এলাকায় কম বেশি ক্ষতি হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে যশোরের ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেক এলাকায় ঘর ভেঙে পড়েছে। কিছু এলাকায় ঘরের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে যশোরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক লোক। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আট উপজেলায় টিন বিতরণ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভেঙে যায় ঘর ঠিক করার জন্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ বান টিন বরাদ্দ হয়েছে। এছাড়া খাদ্যসহায়তা হিসেবে ১০০ মেট্রিকটন চালও বিতরণ হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে যশোরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ বহু স্থাপনা ভেঙে গেছে। অনেক গ্রামের কাচা রাস্তা পানির তোড়ে ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। জেলায় ৫ লক্ষ ৭৮ হাজার ২১৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের পরে এসব ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৩ শ’ বান বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি টিনের বানের সাথে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঝড়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারের মাঝে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করে এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা স্ব স্ব মন্ত্রালয়ের দপ্তরে চাহিদা পাঠিয়েছি।