রাজশাহী

কংক্রিটের সড়ক: বদলেছে সিরাজগঞ্জের চরের জীবনযাত্রা

  প্রতিনিধি ২২ জুন ২০২১ , ৮:৫০:৫৮ প্রিন্ট সংস্করণ

এস এম আল আমিন, সিরাজগঞ্জ :

বর্ষাকালে প্রমত্তা যমুনা পূর্ণ যৌবনের উন্মাদনায় দু’পারের কূল ছাপিয়ে ওঠে। নিজের প্রশস্ত বুকে আশ্রিত লক্ষ প্রাণের অস্তিত্বকে ভুলে মনের আনন্দে দোলে এ নদী।

সাগর সমান পানিতে ভাসতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। বর্ষা যায়, আসে শরৎ ও হেমন্ত। নববধুর মতো নীরব যমুনা তখন ফুলে-ফসলে সজ্জিত হতে থাকে। বসন্তে প্রকৃতি যখন ফিরে পায় নব যৌবন, সংকুচিত হয় যমুনা। বুকে তার জেগে ওঠে শত শত বালিচর। ভিন্ন মৌসুমে ভিন্নরূপে আভির্ভুত বহুরূপী যমুনাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর চিরায়ত কষ্টের কারণ ছিল দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা।

বর্ষা মৌসুমে নৌকাযোগে চলাচল করতে পারলেও শুস্ক মৌসুমে কষ্টের যেন সীমা থাকতো না চরবাসীর। মালামাল পরিবহণের জন্য ঘোড়া বা গরুর গাড়ী ব্যবহার করা গেলেও উত্তপ্ত বালুচরে পায়ে হেঁটেই চলতে হতো মানুষগুলোকে। এখন সেদিন পাল্টে গেছে। যমুনার বুক চিরে নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের সড়ক, বদলে গেছে চরের মানুষের জীবনমান। বালুচরের বুকে গড়ে ওঠা পাকা সড়কের কল্যাণে নতুন দিনের সন্ধান পেয়েছে সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলবাসী।

সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, তেকানি, নিশ্চিন্তপুর, সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়নে সরেজমিনে গিয়ে চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ভ উন্নয়নের চিত্র দেখা যায়। যমুনা গর্ভস্থ এসব ইউনিয়নের মানুষের আন্তযোগাযোগ ব্যবস্থা যেন শহরের মতোই।

নৌকাযোগে কাজিপুর সদর থেকে নাটুয়ারপাড়া ঘাটে পৌঁছার আগেই দূর থেকে দেখা যায় লম্বা একটি কংক্রিটের সড়ক। দীর্ঘ চরের বুক চিরে দূরের কোন গাঁয়ে প্রবেশ করেছে দারুন সৌন্দর্য্যরে সড়কটি। রাস্তায় চলছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, শ্যালো ইঞ্জিন চালিত তিনচাকার বেশ কিছু যানবাহন। এছাড়াও রয়েছে বাইক রাইডার যাত্রীবাহী মোটর সাইকেল।

কিছু দূর যাবার পর দেখা যায় বিশাল বাজার। নাটুয়ারপাড়া নামে এই জনপদটি যেন যমুনার বুকে গড়ে ওঠা এক চিলতে শহর। নাটুয়ারপাড়া স্বাধীনতা চত্বর (গুলমোড় বাজার) থেকে দুটি কংক্রিটের সড়ক দুদিকে চলে গেছে।

পূর্বদিকে চরগিরিশি ঘাট এবং দক্ষিণে নাটুয়ারপাড়া ডিগ্রি কলেজ-পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে তেকানি ইউনিয়ন, পানাগাড়ী হাট, কান্তনগর, জুমার খুকশিয়া পারি দিয়ে সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়নের রূপসা বাজার পর্যন্ত চলে গেছে। অপরদিকে পানাগাড়ি হাট থেকে নতুন আরও একটি রাস্তা পূর্বদিকে নিশ্চিন্তপুর ইউনিয়নের দিকে চলে গেছে। এভাবেই কংক্রিটের সড়কের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে চরাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর আধুনিক আন্তযোগাযোগ ব্যবস্থা।

পানাগাড়ী হাট থেকে ঘোড়ার গাড়ী ছুটিয়ে আসছিলেন ২৪ বছর বয়সী আশরাফুল। তিনি কৃষকের পণ্য বোঝাই করে হাটে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধ তোফাজ্জল হোসেন, আমির আলীসহ চার কৃষক। তারা ঘোড়ার গাড়ীতে সবজি নিয়ে পানাগাড়ী হাটে এসেছিলেন। সেগুলো বিক্রি করে ফিরে যাচ্ছেন তারা। নির্মাণাধীন অপর এক রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সিমেন্টের বস্তা নিয়ে যাচ্ছিলন আউয়াল।

তোফাজ্জল হোসেন বলেন, বাব-দাদার আমল থেইকে বালুর রাস্তায় পায়ে হাইট্যা পানাগাড়ি, নাটুয়ারপাড়া হাটে আইসত্যাম। মাথায় বোঝা নিয়্যা ৫/১০ মাইল গরম বালুর রাস্তাায় দিয়্যা যাতায়াত যে কি কষ্টের-ভাবতেও গাঁয়ে কাটা দেয়। নাটুয়ারপাড়া-রূপসা রাস্তাা হওয়ার পর এ্যাহন ঘোড়ার গাড়িতে ক্ষেতের ফসল তুইল্যা নিজেরা অটোরিকশায় আসি। আগে হাটে আইসতে দেড় ঘন্টা সময় লাইগতো-এ্যাহন লাগে ১৫ মিনিট। নাসিম সাহেব আমাগোরে এই রাস্তা কইর‌্যা দিছে। আল্লাহ যেন তাকে কবরে ভাল রাখেন-মনের আবেগেই কথাগুলো বলে ফেলেন তোফাজ্জল হোসেন।

কথা হয় আক্তার হোসেন, রাব্বি, জুলমাত আলী, মাহমুদ হাসান, বাদশা আলম, জাহাঙ্গীর হোসেনসহ বিভিন্ন বয়সী কয়েক ব্যক্তির সাথে। চরের অতীত ও বর্তমান জীবনের পার্থক্য তুলে ধরে তারা বলেন, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি ও ধুনট, সিরাজগঞ্জের সদর ও কাজিপুর এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার যমুনা গর্ভস্থ চরাঞ্চলগুলোর অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র নাটুয়ারপাড়া হাট ও বাজার। এ হাট-বাজারকে ঘিরেই চরের মানুষের অর্থনীতির চাকা ঘোরে।

স্বাধীনতার আগে থেকেই বর্ষা মৌসুমে নৌকা আর শুস্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটে এবং গরু-ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল তুলে নাটুয়ারপাড়া হাটে যাতায়াত করতো অত্র অঞ্চলের সকল পর্যায়ের জনসাধারণ। শুস্ক মৌসুমে বগুড়ার সারিয়াকান্দি কিংবা সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মেছড়ার চর থেকে এ হাটে আসতে তিন থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগতো। তাছাড়াও চরের মানুষ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের আত্মীয়ের বাড়ি যেতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় লাগতো। চরবাসীর কষ্টের যেন কোন শেষ ছিল না।

১৯৯৭ সালে নাটুয়ারপাড়া থেকে চরগিরিশ পর্যন্ত প্রথম পাকা রাস্তা নির্মাণের পর এখানকার মানুষ স্বপ্ন দেখতে থাকে। এরপর ২০০৯ সালে নাটুয়ারপাড়া-রূপসার চর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি নির্মিত হওয়ার পর চরের চেহারাই পাল্টে যায়।
এক সময় পায়ে হেঁটে চলা মানুষগুলো এখন, অটোরিকশা, সিএনজি কিংবা ব্যাটারি চালিত ভুটভুটিতে চলাচল করে।

তেকানি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ বলেন, কাজিপুর এলাকার বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের হাতেগড়া উন্নয়নে ভাসছে এখন চরের মানুষ। অনেক রাস্তা হয়েছে। আরও নতুন নতুন রাস্তা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।

কাজিপুর উপজেলা সহকারি প্রকৌশলী আব্দুস সালাম বলেন, যমুনার অভ্যন্তরে চরাঞ্চলে প্রায় ১৯টি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ৫৭ কিলোমিটার।

তিনটি রাস্তা হয়েছে ১৯৯৬-২০০১ সালের মধ্যে। বাকি ১৬টি রাস্তা ২০০৮-২০২০ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছে। এ রাস্তাগুলো নির্মাণ হওয়ায় নাটুয়ারপাড়া-তেকানী-নিশ্চিন্তপুর-চরগিরিশি-মনসুরনগর, মেছড়া ও কাওয়াকোলা ইউনিয়ন ছাড়াও সরিষাবাড়ীর কিছু অংশের সাথে আন্ত:যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে বলে জানান তিনি।

কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘গ্রাম হবে শহর-মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে বাস্তবায়ন করতে আমরা কাজ করছি। চরাঞ্চলের মানুষের মাঝেও এখন শহরের সুবিধা পৌঁছে গেছে। নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। গত চারমাসে টি-আর কাবিখার বরাদ্দ থেকে ৪০ কিলোমিটার মাটির রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এ রাস্তাগুলো এক সময় পাকা রাস্তায় পরিণত হবে।

সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর ও সদরের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিম পুত্র প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় বলেন, কাজিপুর উপজেলার প্রায় অর্ধেক মানুষ চরাঞ্চলে বাস করে। জনগণের বিরাট এই অংশটির কথা মাথায় রেখে আমার বাবা মোহাম্মদ নাসিম ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত তিনটি পাকা রাস্তা নির্মাণ করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় চরের রাস্তা নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পরে।

এরপর ২০০৮ সালে বাবা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারায় আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাবার অনুপ্রেরণায় আবারও চরের রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগী হই। ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৬টি রাস্তা নির্মাণ দুর্গম চরের মানুষের মধ্যে আন্ত:যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়।

আরও নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। করোনার কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। তবে আশা করি এই সরকারের মেয়াদেই আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তা পাকা করতে পারবো।

 

 

আরও খবর

Sponsered content

Powered by