দেশজুড়ে

চিনিকলে উৎপাদন বন্ধের ঘোষণায় দিশেহারা শ্রমিক-চাষি

  প্রতিনিধি ১২ ডিসেম্বর ২০২০ , ১২:০৫:৪১ প্রিন্ট সংস্করণ

রংপুরের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেডে ২০ বছর ধরে ট্রাকচালক হিসেবে কর্মরত আছেন রাজা মিয়া (৫০)। লোকসানের মুখে চলতি মৌসুমে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সুগার মিলটিতে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এ আশঙ্কায় এখন দিন কাটছে রাজা মিয়ার।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। চাকরি না থাকলে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা আর সংসারের খরচ কীভাবে চলবে সে চিন্তাই যেন এখন তাকে ঘিরে ধরেছে।

রাজা মিয়ার মতো ওয়ার্কশপ (জুনিয়র টানার) কর্মচারী আলামিন ও ওয়ার্কশপ সহকারী মোকছেদ আলীও এখন চোখে-মুখে কেবলই ঘোর অন্ধকার দেখছেন।
গত দুই সপ্তাহ ধরে শ্যামপুর চিনিকল অ্যামপ্লয়িজ ইউনিয়ন ও আখচাষি কল্যাণ সমিতির আয়োজনে চলমান বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তারা। অন্য শ্রমিক-চাষিদের মতো তাদেরও দাবি, যেন বন্ধ করা না হয় এ কারখানাটি। প্রায় ৩শ স্থায়ী শ্রমিকসহ চুক্তিভিত্তিক ও মৌসুমি মিলে সাত শতাধিক শ্রমিক রয়েছেন এ কারখানায়। যাদের আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ হয় তাদের পরিবারের। কারখানা বন্ধ হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাগত দিনগুলোতে কী হবে তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না এসব শ্রমিকরা।

এছাড়া আখচাষিরাও পড়েছেন বিপাকে। প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার আখচাষি ও তাদের পরিবারসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিনমজুর, ব্যবসায়ী মিলে দেড় লাখ মানুষের আয়-রোজগারের নির্ভরতা এই সুগার মিল। কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের মতা তারাও এখন দিশেহারা। কারখানা বন্ধ হলে হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন।

ট্রাকচালক রাজা মিয়া জানান, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার পরিবার। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে রংপুর ক্যান্টপাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। চাকরির আয় দিয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ বহন করতেন। এখন চাকরি না থাকলে বিপদে পড়তে হবে তাদের।

শ্যামপুর বসন্তপুর এলাকার কৃষক হামিদুল হক জানান, তার তিন বিঘা জমি রয়েছে। প্রতিবছর এক বিঘা জমিতে আখচাষ করেন। অন্য ফসলের চেয়ে শ্রম ও ব্যয় কম হওয়ায় আখচাষ লাভজনক। সাধারণত বালু ও উঁচু মাটিতে আখচাষ করা হয়। মিল বন্ধ হলে আখের বদলে অন্য ফসল চাষ করা গেলেও ততটা লাভজনক হবে না। তাই তিনিও চিন্তিত।

খৈল্লাপাড়ার কৃষক শহিদার রহমানের ১০০ শতক জমির মধ্যে প্রতিবছর ৭৫ শতক জমিতে আখ চাষ করেন। তার মতে, আখচাষে শ্রম ও ব্যয় কম। তাই লাভজনক।

ধান, গমসহ বিভিন্ন ফসলের মতো আখেরও হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন এবং মেয়াদকাল কমিয়ে আনলে আখচাষে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতেন কৃষক। এজন্য মিল বন্ধ না করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে উন্নতজাতের আখ উৎপাদনের জোর দাবি জানান আখচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান সাগর।

মিল কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক ও আখচাষি সূত্রে জানা যায়, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্যামপুর সুগার মিল ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ, ঋণের সুদ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন খাত মিলে ৫০৫ কোটি টাকা লোকসানের ঘানি টানতে হয়েছে। এরমধ্যে গত ২০১৯-২০ মৌসুমে লোকসান গুণতে হয়েছে ৬১ কোটি টাকা। অব্যাহত লোকসানের মুখে চলতি মৌসুমে আখ মাড়াই বন্ধ করা হয়।

আখচাষিদের পাওনা বকেয়া না থাকলেও শ্রমিক-কর্মচারীদের চার মাসের বেতন (মে, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর) প্রায় ৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

এদিকে আখ উৎপাদন কমে যাওয়া ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে লোকসানের বোঝা বাড়ছে বলে মিল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও তা মানতে নারাজ শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষিরা।

তাদের দাবি, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অদক্ষ জনবল ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে প্রতি বছর লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে।

জানতে চাইলে শ্যামপুর সুগার মিল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, অদক্ষ কর্মকর্তা, যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে দুর্নীতি, বিভিন্ন প্রকল্পের নামে টাকা আত্মসাৎ এবং অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে এই কারখানাটি লোকসানের মুখে পড়ছে।

দেশের ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে শ্যামপুর চিনিকল দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডে অবস্থান করলেও লোকসানের অজুহাতে তা পুরোপুরি বন্ধের পায়তারা করা হচ্ছে। কারখানাটি বন্ধ না করে কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করে এটি চালু রাখার জোর দাবি জানান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীলিপ কুমার সরকার বলেন, যেখানে ৫ মাস মিল চালু রাখার কথা, সেখানে পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ায় তার আগেই চিনি উৎপাদন বন্ধ করতে হয়। আখ উৎপাদন কমে যাওয়া এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। এ কারণে প্রতিবছর লোকসান বাড়ছে।

কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে লোকসান হচ্ছে-শ্রমিকদের এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সঠিক না। আমি কিছুদিন আগে গত ৮ জুলাই যোগদান করেছি। এ ধরনের কিছু জানা নেই।

তিনি বলেন, মিল বন্ধ নয়, চলতি মৌসুমে আখমাড়াই বন্ধ রাখা হয়েছে এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

শ্যামুপর সুগার মিল এলাকায় উৎপাদিত আখ মিল ব্যবস্থাপনায় জয়পুরহাট চিনিকলে নিয়ে যাওয়া হবে। এতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না বলেও তিনি জানান।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by