আন্তর্জাতিক

দেশত্যাগী হাজার হাজার আফগানের গন্তব্য কোথায়?

  প্রতিনিধি ২৬ আগস্ট ২০২১ , ৩:১৩:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্ক:

আফগানিস্তানে দু’দশক পর তালেবানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসার সময় থেকেই সেখানে অবস্থান করা বিদেশিদের সাথে হাজার হাজার আফগানও দেশ ছাড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। প্রায় ২২ লাখ আফগান ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে এবং আরও প্রায় ৩৫ লাখ আফগান দেশের সীমানার মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

তবে ঠিক কত আফগান দেশ ছেড়েছেন, তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এ মুহূর্তে বলা কঠিন – কিন্তু বিমানে করে কতজন দেশ ছেড়েছে তার কিছু হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। বুধবার যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে যে, তারা এ পর্যন্ত ৮০ হাজারের মতো মানুষকে কাবুল বিমানবন্দর ব্যবহার করে সরিয়ে এনেছে।

গত ১৪ আগস্টের পর থেকে আফগানিস্তানে কেবল এই একটি বিমানবন্দরই সক্রিয় আছে। তবে এই ৮০ হাজারের মধ্যে কতজন আফগান নাগরিক, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনও নেই।

অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ১০ হাজারের বেশি মানুষকে সরিয়ে নিয়েছে এবং এর মধ্যে আফগান নাগরিকের সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। এছাড়া, জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা সাড়ে চার হাজার ব্যক্তিকে কাবুল বিমানবন্দর দিয়ে সরিয়ে নিয়েছে, যার মধ্যে ৩ হাজার ৭০০ জনই আফগান।

তবে সরিয়ে নেওয়া এসব ব্যক্তির মধ্যে কিছু স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীও রয়েছেন। আর সরিয়ে নেওয়া আফগানদের মধ্যে অর্ধেকই নারী ও শিশু। বিমানে করে কাবুল থেকে সরিয়ে আনার কার্যক্রম গত কয়েকদিনে বেশ গতি পেয়েছে।

কত মানুষ আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে?
বিদেশে যেতে চান এবং অনুমতিও রয়েছে এমন আফগানদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ তালেবান চায় না আফগানরা দেশ ত্যাগ করুক। তবে এটাও ঠিক পরিষ্কার নয় যে ঠিক কত সংখ্যক আফগান দেশ ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পেরেছেন।

ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির হিসেবে, ২০০১ সালের পর থেকে প্রায় তিন লাখ আফগান নাগরিক মার্কিন অভিযানে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন এবং এর মধ্যে অনেকেই মার্কিন ভিসা পাওয়ার যোগ্য। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের ভিসা পাওয়ার যোগ্য এমন দু’হাজার আফগানকে এখনও সরিয়ে নেওয়া হয়নি বলে বিবিসিকে জানানো হয়েছে।

বিবিসির একজন সংবাদদাতা মঙ্গলবারও কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে আফগানদের ভিড় দেখেছেন, যারা ভিসা পাবেন বলে আশা করছেন। কিন্তু ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তালেবান যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে তাদের সবাই দেশ ছাড়তে পারবেন এমন সম্ভাবনা কম।

আফগানিস্তান ছাড়ার অন্য যেসব বিকল্প পথগুলোও খুব সীমিত। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে স্থলসীমান্ত পথ পুরোটাই এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে এবং তারা আফগানদের দেশের বাইরে যেতে দিতেও রাজি নয়।

বিভিন্ন খবরে দেখা যাচ্ছে, শুধু ব্যবসায়ী এবং যাদের ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র আছে, তাদেরকেই সীমান্ত পার হওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘বেশিরভাগ আফগান নিয়মিত চ্যানেলে দেশ ছাড়তে পারবেন না। এখন পর্যন্ত যারা বিপদে আছেন, তাদের সবার সামনে পরিষ্কার কোনো উপায়ও নেই।’

তবে কিছু শরণার্থী অবশ্য নিজ ব্যবস্থাপনায় সীমান্ত অতিক্রমের উপায় বের করে নিয়েছেন। এরই মধ্যে কয়েক হাজার আফগান নাগরিক পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, আর প্রায় দেড় হাজার আফগান উজবেকিস্তানে প্রবেশ করে এখন সীমান্তের কাছে তাবুতে দিন কাটাচ্ছেন।

ঘরবাড়ি থেকে পালিয়েছে কত মানুষ?
অস্থিতিশীলতার শিকার আর যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মানুষদের দেশ ছাড়ার লম্বা ইতিহাসে এবারে যুক্ত হলো বড় সংখ্যায় আফগানদের দেশত্যাগের চেষ্টা। সাথে যোগ হয়েছে বাস্তুচ্যুত হওয়ার নতুন ঘটনা। জাতিসংঘের হিসেব বলছে, তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে লড়াই আর সংঘাতের কারণে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ।

এর অর্থ হলো, এখন অন্তত সাড়ে ৩৫ লাখ আফগান দেশের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত। এছাড়া আরও ২২ লাখ শরণার্থী গত বছরের শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয়ের আবেদন করে অপেক্ষা করছিল।

আফগান শরণার্থীরা কোথায় যাবে?
গত বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক আফগান শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী গেছে ইরান আর পাকিস্তানে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে পাকিস্তান গেছে প্রায় ১৫ লাখ আর ইরানে গেছে সাত লাখ ৮০ হাজার আফগান। এরপরে সর্বোচ্চ এক লাখ ৮০ হাজার আফগান আশ্রয় নিয়েছে জার্মানিতে, আর এক লাখ ৩০ হাজার তুরস্কে।

অন্য দেশে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন কিন্তু আবেদন এখনও গৃহীত হয়নি, এমন আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে তুরস্ক, জার্মানি আর গ্রিস রয়েছে এমন তালিকার শীর্ষে – এসব দেশে যাওয়ার জন্য যথাক্রমে এক লাখ ২৫ হাজার, ৩৩ হাজার ও ২০ হাজার আফগান আবেদন করে বসে আছেন।

অন্যদিকে, ইরানে যারা শরণার্থী কার্ড পেয়েছেন তাদেরকে দেশটির শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

অন্য দেশগুলো কতটা সহায়তা করছে?
কিছু দেশ আফগানদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে, আবার কিছু দেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে পালিয়ে যাওয়া আফগানদের জন্য তারা ততটা উদার হবে না।

ইরান: আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে শরণার্থীদের জন্য তাঁবু খুলেছে ইরান। ইরানের একজন কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন যে, পরিস্থিতি ভালো হলে আফগানদের প্রত্যাবাসন করা হবে। দেশটিতে ইতোমধ্যেই প্রায় ৩৫ লাখ আফগান আশ্রয় নিয়েছে।

পাকিস্তান: গত জুনে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিলে তার দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেবে। যদিও জানা গেছে যে অন্তত একটি জায়গায় সীমান্ত খোলা আছে এবং কয়েক হাজার আফগান ইতোমধ্যেই পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন।

তাজিকিস্তান: আফগান ন্যাশনাল আর্মির সদস্যসহ কয়েকশ আফগান সম্প্রতি সীমান্তপথে তাজিকিস্তানে প্রবেশ করেছেন। জুলাইতে দেশটি জানিয়েছে, তারা এক লাখ আফগান শরণার্থী গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

উজবেকিস্তান: প্রায় দেড় হাজার আফগান শরণার্থী উজবেকিস্তান সীমান্তের মধ্যে তাঁবু গেড়েছেন। এখানে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান।

যুক্তরাজ্য: বিশ হাজার আফগানকে গ্রহণ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। এর মধ্যে প্রথম বছরে পাঁচ হাজার আফগানকে পুনর্বাসন করা হবে, যার মধ্যে নারী, শিশু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা গুরুত্ব পাবে।

যুক্তরাষ্ট্র: আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকিতে পড়া শরণার্থীদের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি তহবিলের অনুমোদন দিয়েছেন। তবে ঠিক কত সংখ্যক শরণার্থী যুক্তরাষ্ট্র নেবে, তা জানানো হয়নি।

কানাডা: কানাডায় ২০ হাজার আফগান শরণার্থীকে গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে এর মধ্যে তালেবানের কারণে বিপদে থাকা সাবেক আফগান সরকারের কর্মী এবং নারীনেত্রীরা অগ্রাধিকার পাবে।

তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে যে, তারা ২০১৫ সালের শরণার্থী সংকটের পুনরাবৃত্তি চায় না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যেই বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে শরণার্থীর ঢেউ থেকে ইউরোপকে সুরক্ষা দিতে হবে। তবে খুব বিপদে থাকা লোকদের তার দেশ সুরক্ষা দেবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

অস্ট্রিয়া কোনো শরণার্থী না নেওয়ার কথা জানিয়েছে, আর সুইজারল্যান্ড বলেছে যে, সরাসরি আফগানিস্তান থেকে আসা বড় সংখ্যক শরণার্থীকে তারা গ্রহণ করবে না। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া তিন হাজার এবং আফ্রিকার দেশ উগান্ডাও দুই হাজার আফগান শরণার্থীকে গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে।

আর যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে উত্তর মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া এবং কসোভো কিছু শরণার্থীকে সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার আগে পর্যন্ত এসব শরণার্থী সেখানে থাকবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আরও খবর

Sponsered content

Powered by