দেশজুড়ে

পরিবার সামলেও বিসিএসে সফল নূর ই জান্নাত

  প্রতিনিধি ২৮ আগস্ট ২০২৩ , ৭:০৯:২৩ প্রিন্ট সংস্করণ

পরিবার সামলেও বিসিএসে সফল নূর ই জান্নাত

অদম্য ইচ্ছাশক্তি, সাহস আর পরিবারের সাপোর্ট সবমিলিয়ে স্বামী-সন্তান পরিবার সামলেও যে, কাংখিত সাফল্যে পৌঁছা যায় তার প্রমাণ ৪১তম বিসিএসে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত নুর-ই-জান্নাত। পৈত্রিক নিবাস ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলায় হলেও জান্নাতের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায়। স্কুল শিক্ষক পিতা আবুল কালাম আজাদ ও গৃহিনী মাতা আমেনা খাতুনের বড় সন্তান জান্নাত। পরিবারে তার ছোট দুই ভাই আছে। তাদের মধ্যে একজন বর্তমানে একটি বেসরকারী কলেজে লেকচারার হিসেবে কর্মরত, অন্যজন পড়ালেখায় ব্যস্ত। ভাই-বোন তিনজনই মেধাবী হিসেবে বরাবর ভাল ফলাফল করেছে শিক্ষা জীবনে।

নুর-ই-জান্নাত আগ্রাবাদ বালিকা বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি, সরকারী কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতকত্তোর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার পর পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়ে যায় মেধাবী জান্নাতের। স্বামী এসএম মঈনুল হোসেন একজন ব্যবসায়ী। সংসারে রয়েছে ৫ বছরের একটি পুত্র সন্তান। হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কিছুটা হতাশা কাজ করলেও পড়ালেখায় তার ছেদ ঘটেনি। সাফল্যের সাথেই অনার্স এবং মাষ্টার্স সম্পন্ন করেন প্রথম শ্রেণি অর্জণের মধ্য দিয়ে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বিসিএস ক্যাডার হবেন। কিন্তু হঠাৎ করে বিয়ে-সংসার সন্তান সবকিছু মিলিয়ে কিছুটা ঝামেলায় আটকে গেলেও লক্ষ্যে ছিলেন অটুট। ফলে সাফল্য আসে ৪১তম বিসিএসে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে।

পরিবার, স্বামী, সন্তান সামলে যেভাবে দৃঢ় মনোবল আর অদম্য ইচ্ছাই তাকে সফলতা এনে দিয়েছে। তার এ অর্জনের পাশে শিক্ষক বাবার অনুপ্রেরণা, লেকচারার ভাইয়ের মোটিভেশন, ব্যবসায়ী স্বামীর সমর্থন তাকে অনেক সাহস জুগিয়েছে। লক্ষ্য স্থির রেখে কোনো কোচিং না করেই এমন সাফল্য অসম্ভব মেধা এবং অদম্য ইচ্ছারই সফল বহিঃপ্রকাশ।

জান্নাতের নিজের মুখে বিসিএসের প্রস্তুতিঃ বিসিএস নিয়ে অনার্স চতুর্থ বর্ষ থেকেই আগ্রহ ছিল। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার কনফিডেন্সে প্রিলিমিনারির জন্য ভর্তি হলেও কোর্স শেষ করা হয় না বিভিন্ন কারণে। বাবা ছোটবেলা থেকে বিসিএস এর ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই ২০১৩ সালের দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনালের পর। সংসার জীবন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ার কারণে তুমুল প্রতিযোগিতার পরীক্ষা বিসিএস এর ময়দানে কিছুদিন প্রিলির ক্লাস করে আশা ছেড়ে দিই। ২০১৮ সালের জুলাই মাসের প্রথমবারের মতো মা হই।

প্রথম তিন-চার মাস মাতৃত্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এরপর মনে হলো আমার বিসিএস জার্নি এভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। আমার সন্তান বড় হয়ে তার ময়ের একটা ভালো পরিচয় দিবে এই ভাবনাটা আমাকে তাড়া করে। মনে পড়ে যায় বাবার স্বপ্নের কথা! বয়সসীমা আছে আর দুই বছর। আমার ভাবনার জগতে তোলপাড় হতে থাকে বিসিএসের চিন্তা নিয়ে। এর মধ্যে আমার ছেলের বয়স এক বছর পূর্ণ হল। আমার ছোট ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আজাদ (বর্তমানে আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ লেকচারার হিসেবে কর্মরত) তার অনুপ্রেরণায় আমি স্থির করলাম আবার প্রস্তুতি নিব। ভাই আমাকে বিভিন্ন কোচিং এর ওরিয়েন্টেশনে যেতে বলে। আমি ওরিয়েন্টেশন ক্লাসগুলো করে লক্ষ্য স্থির করলাম যে, বিসিএস প্রস্তুতি নিবই। তারপর থেকে কোনো কোচিং করিনি তবে ছোট ভাই সবসময় সড়হরঃড়ৎরহম করতো। বিভিন্ন বই, সাজেশন, মোটিভেশন সে সবসময় দিতো।

আড্ডা শপিং এড়িয়ে যেভাবে পড়েছিঃ বাচ্চার দেখাশোনা আর ঘরের কাজের পাশাপাশি প্রিলির প্রস্তুতি নিতে থাকি। আড্ডা কিংবা Gossiping, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া অনেক কমিয়ে দিই। টুকটাক কাজের সময় মোবাইল অ্যাপসে পরীক্ষা দিতে দিতে কাজগুলো করতাম। ফেসবুক, ইউটিউবের মোটিভেশন speech গুলো যখন দেখতাম, তখন সংসার, বাচ্চা, পড়াশোনা ব্যালেন্স করতে গিয়ে হিমশিম খেতাম।

পরীক্ষায় প্রথম অংশ নেয়া এবং সাফল্য যেভাবে আসেঃ ২০২১ সালের ১৯ মার্চ এক বুক আশা নিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম। সেই বছর ১ আগস্ট রেজাল্ট দেয়, নিজের রোল দেখে অনেক আনন্দিত! সত্যি কথা বলতে চূড়ান্ত সুপারিশে নিজের রোল দেখার চেয়েও প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম। তারপর লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিই খুব কম সময়ে। এই সময় ছেলেকে দেখাশোনা করতেন আমার মা। লিখিত পরীক্ষায় আমারstrong zone ছিল ইংরেজি। অন্যান্য বিষয়ে ফাউন্ডেশন মোটামুটি ভালো ছিল। কোন কোচিং করা হয়নি, তবে মডেল টেস্ট দিয়েছিলাম। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়। ভাই অনেকভাবে মোটিভেট করে যেহেতু আমি কিছুটা stressed ছিলাম। পরীক্ষা ভালোভাবেই দিই এবং খুব সুন্দরভাবে Informative data উপস্থাপন করি। ইংরেজি পরীক্ষা অনেক বেশি ভালো হয়। তারপর ২০২২ সালের মে মাসের ২১ তারিখে আমার ভাইবার তারিখ। চরম উৎকন্ঠা আর সীমাহীন দুশ্চিন্তা, যেহেতু এটাই জীবনের শেষ সুযোগ এবং একমাত্র সুযোগ তবুও অনেক সাহস নিয়ে ভাইবা দিতে যাই। প্রস্তুতি মোটামুটি ভালই নিয়েছি। ভাইবার রুমে বেশ Confident & Spontaneous ছিলাম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর ফলাফল প্রকাশিত হয়। আল্লাহর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া নিজের Roll দেখতে পাই।

বিসিএসের আগেই দুই চাকরীঃ ইতোমধ্যে জেলা পুলিশ লাইন স্কুল, হালিশহরে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। সরকারি প্রাথমিকে এই বছরের জানুয়ারি মাসে যোগদান করি। যেহেতু তখনও ফলাফল প্রকাশিত হয়নি, সেহেতু শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে মোহাম্মদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করি

যারা ক্যাডার হতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে বলবোঃ পড়াশোনার ব্যাপারে Dedication থাকতে হবে অনেক বেশি। আশেপাশের লোক Negative Attitude দেখাতে পারে তবে লক্ষ্য বিচ্যুত হওয়া যাবে না। প্রতিদিন পড়তে হবে এবং বারবার পড়তে হবে। আমি অনেক রাত ঘুম ত্যাগ করেছি আর Shopping, Gossiping থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। এগুলো আমার যোগ্যতা বা অযোগ্যতা নয়, এগুলো বিসিএস এর জন্য আমার Dedication। আমার এই জার্নিতে সবসময় আমি ডেডিকেটেড ছিলাম যা আমাকে সফলতা এনে দিতে সাহায্য করেছে।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by