রাজধানী

বিধিনিষেধের জীবন: অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে শুরু জীবিকার লড়াই

  প্রতিনিধি ১১ আগস্ট ২০২১ , ৮:৪১:৪৫ প্রিন্ট সংস্করণ

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মাঝে কয়েকটা দিন বিরতি দিয়ে গত এপ্রিল থেকে টানা বিধিনিষেধের (লকডাউন) মধ্যে ছিল গোটা দেশ। এতে জনজীবন অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। প্রবল আকার ধারণ করে জীবন-জীবিকার সংকট। বেঁচে থাকা এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখায় জীবিকার সংগ্রামই একটা সময় মুখ্য হয়ে দাঁড়ালে সংক্রমণের চরম পরিস্থিতির মধ্যেই বিধিনিষেধ থেকে সরে আসার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় সরকার। কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় বুধবার থেকে ফের জীবিকার সংগ্রামে নেমেছে মানুষ।

 

বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় বুধবার থেকে অফিস আদালতসহ সকল প্রতিষ্ঠান খুলেছে। বাস, ট্রেন, লঞ্চ চলাচলের পাশাপাশি খুলেছে দোকানপাট-শপিংমল। ভোর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কর্মজীবী মানুষের ব্যস্ততা দেখা গেছে। চলছে গণপরিবহণ। যানজটে যেন আবার সেই পুরোনো শহরে পরিণত হয়েছে।

বন্দিজীবন থেকে কর্মজীবনে ফিরলেও মানুষের মুখে মুখে বিরাজ করছে হতাশার ছাপ। সব কিছু স্বাভাবিক হলেও এ যেন অনিশ্চিত যাত্রা। বিধিনিষেধ উঠলেও নানা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, করোনা মহামারিতে খাদে পড়ে যাওয়া অসহায়, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অসহনীয় অধ্যায়ের এবার কি অবসান হবে? করোনায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি সহসা পুষিয়ে উঠতে পারবে? যারা কর্ম হারিয়ে দুর্বিসহ জীবন পার করছেন তাদের কর্মে ফেরা বা কবে হবে কিংবা কবে মানুষ আবার সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর হয়ত সহজে পাওয়া যাবে না। নানা অনিশ্চিয়তার মধ্যেই জীবন-জীবিকার সংগ্রাম শুরু হয়েছে।

বিধিনিষেধ শিথিলের প্রথম সকালে কাকরাইল মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আবু সুফিয়ান। গুলশানে তার অফিস। বাস তখনো আসেনি। তারপরও তার যেন তাড়াহুড়োর শেষ নেই। এরই মাঝে কথা হলে সুফিয়ান বলেন, ‘করোনায় যে জটিল জীবন ধারণ করেছে তাড়াহুড়ো তো থাকবেই। আমার মতো মহাসংকটে পড়া মানুষদের পিছনে তাকানোর সময় নেই। কোথাও আশার আলো দেখছি না। জীবন তো বাঁচাতে হবে।’

কথায় কথায় এই পেশাজীবী আরো বলেন, ‘লকডাউনে কাজ বন্ধ থাকায় গত ঈদের বোনাস পাই নাই। বেতন যা পাইছি কোরবানী করে ঈদটা কোনমত কেটেছে। এখন ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি। আমার মার্কেটিংয়ের চাকরি। নিজের প্রতিষ্ঠান যেমন খোলা থাকতে হয়, আবার অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু লকডাউনে তো সবই বন্ধ ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘এবারের ঈদে বোনাস পাইনি , এ মাসের বেতনটা পাই কিনা এখনো বলতে পারছি না। আবার লকডাউনে মাসের দশদিন তো চলে গেলো আগামী মাসে পুরো বেতন পাবো কিনা অনিশ্চিত। কতটা দুর্বিসহ জীবন পারছি বলে বুঝনো যাবে না। এ সংকট থেকে কবে যে মুক্তি পাবো কোন নিশ্চয়তা নেই।’

শুধু আবু সুফিয়ানই নয়, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের এমন গল্প প্রায় সবারই। শাহাবাগ মোড়ে কথা হয় আফজল হোসেনের সঙ্গে। এলিফেন্ট রোডে একটি বস্ত্রালয়ের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। হাতে খাবারের বক্স নিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন কর্মস্থলের দিকে।

কথা হলে আফজাল বলেন, ‘ভাই, আমাদের কথা শুনে লাভ নাই। চাকরি করেও গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা এনে চলতে হচ্ছে। পুরানা ঢাকায় ছোট একটা রুম নিয়ে থাকছি। করোনায় বিপদে পড়ে গত বছরই পরিবারের সবাইকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে কিছু বেঁচে গিয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘এবার বেতন থেকে কোরবানি ও পরিবার চলার জন্য টাকা দিছিলাম। কিন্তু ঈদের পর আবার গ্রাম থেকে ঋণ করে টাকা এনে চলতে হচ্ছে। ঈদের আগেও আনছি। লকডাউন শেষ হলো আবার কবে হয় বলা যায় না। মহাবিপদে পরছি। দোকান বন্ধ তো আমাদের বেতন বন্ধ। আবার খোলা হলে কাজও অতিরিক্ত করতে হচ্ছে। ৮ জনের মধ্যে ২ জন কর্মচারী রেখেন মালিক। ম্যানেজার হলেও কর্মচারীর মতোই কাজ করতে হচ্ছে।’

যারা প্রথম দিন কাজে বেরিয়েছেন তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, করোনা মহামারির কারণে অনিয়মিত তাদের বেতন-ভাতা। কাজ করলেও বেতন-ভাতা মিলছে না। বিশেষ করে শিল্প কারখানার কর্মীরা সংকটের মুখে। অনেক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়েছে। আবার অনেক কারখানা বন্ধ হবার পথে।

করোনার ধাক্কায় দেশের অর্থনীতির স্বাভাবিক চাকা আপন গতিতে ঘুরতে পারছে না। সচলতার পরিবর্তে প্রবল হয়ে উঠছে স্থবিরতা। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। অনিশ্চয়তার প্রহর ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দিশেহারা হয়ে অনেক মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যবসায়ীদের অনেকেই করোনায় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। প্রায় সব মানুষই জীবনযুদ্ধের এক কঠিন সময় অতিবাহিত হয়েছে।

করোনার কারণে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় বিধিনিষেধের জীবন। এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে মহামারীর প্রকোপ কিছুটা কমে এলে শিথিল হয় বিধিনিষেধ। মূলত তখন থেকেই দেশের সমাজচিত্র অনেকটাই বদলে যায়। চলতি বছর মার্চের শেষে আবার আগের বছরের চেয়ে ভয়াল থাবা হানে করোনা। বাধ্য হয় সরকার বিধিনিষেধ ঘোষণায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে আবারও শুরু হয় বিধিনিষেধ। এরপর ধাপে ধাপে বাড়ানো হয় এটি।

গত ১৪ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন চলার পর কোরবানির ঈদে পশুর হাটে বেচাবিক্রি ও ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে আট দিনের জন্য শিথিল করা হয়। পরে ঈদের ছুটি শেষে ২৩ জুলাই থেকে আবার শুরু হয় কঠোর বিধিনিষেধ। ৫ আগস্ট পর্যন্ত হলেও আরেক দফায় বাড়িয়ে ১০ আগস্ট করা হয়। অবশেষে মানুষের জীবন-জীবিকার তাগিদ ও অর্থনৈতিক চাকা গতিশীলে বিধিনিষেধ থেকে সড়ে আসার কথা জানায় সরকার। করোনা পরিস্থিতি অবনতির দিকে থাকলেও আগেই ঘোষণা করা সবকিছু ধাপে ধাপে খুলবে। শুরুতে বিধিনিষেধের মধ্যেই শিল্প কারখানা খোলে দেয়া হয়।

দীর্ঘ সময় ধরে বিধিনিষেধ চললেও এখনো করোনার সংক্রমণ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়ে গেছে। বিশেষ করে মৃত্যুর সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে। করোনায় মৃত্যু এখন গড়ে ২০০ জনের বেশি। এরপরও পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ৩ আগস্ট আন্তমন্ত্রণালয় সভায় দেশের আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিধিনিষেধ শিথিলের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পরবর্তিতে বিধিনিষেধ শিথিলের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by