দেশজুড়ে

মানবিক আচরনে পুলিশের প্রশংসা এখন মানুষের মুখে মুখে

  প্রতিনিধি ১৭ জুন ২০২০ , ১:২৫:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ

এসএম ওমর আলী সানি, আগৈলঝাড়া(বরিশাল) : পুলিশ মানেই রুক্ষ মুখ, নীল পোশাক আর লাঠিপেটা করার যন্ত্র নয়, পুলিশের কঠোর বহিরঙ্গের আড়ালে নরম একটা মন রয়েছে। সেই ধারনার শাখা প্রশাখা ছড়াতে শুরু করেছে বরিশালের প্রতিটি অঞ্চলে। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানবিক পুলিশের আচরনে পুলিশের প্রশংসা এখন মানুষের মুখে মুখে।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে চলছে সাধারণ ছুটি কিন্তু পুলিশ সদস্যদের কোন ছুটি নেই। সরকারের নির্দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে দিন রাত কাজ করার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ সকল শ্রেনীর মানুষের জন্য সব রকমের কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা। সাধারণ মানুষের যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য ঘরে ঘরে খাবারও পৌঁছে দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।

এইতো কয়েকদিন আগের ঘটনা। করোনার কারণে সরকারের নির্দেশে ঘরে বন্দি হয়ে পরেন প্রতিবন্ধী গৌরী হালদারের দিনমজুর স্বামী মিলন হালদার। ফলে চার সদস্যর পরিবারে তাদের চরম খাদ্য সংকট চলতে থাকে। প্রতিদিন ত্রাণের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাতের ওপর ভর করে চলা শারিরিক প্রতিবন্ধী গৌরী হালদার বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে থাকেন। কিন্তু তার ভাগ্যে জোটেনি কোন ত্রাণের খাদ্য সামগ্রী। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে তাৎক্ষনিক প্রতিবন্ধী গৌরী হালদারের বাড়িতে পায়ে হেঁটে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী নিয়ে হাজির হন জেলার আগৈলঝাড়া থানার চৌকস অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আফজাল হোসেন।

উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের ফুল্লশ্রী গ্রামের গৌরী হালদারের বাড়িতে গিয়ে ওসি যখন তার (গৌরী) হাতে চাল, ডাল, পিয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তুলে দিয়েছেন তখন হাউমাই করে কেঁদে ফেলেন প্রতিবন্ধী গৌরী। ওসি আফজাল হোসেন জানান, করোনায় জেলা পুলিশের বিশেষ উদ্যোগে আগৈলঝাড়ার শতাধিক পরিবারের মাঝে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও তিনি তার বেতনের টাকায় বাকাল, জবসেন, দাসেরহাট, পূর্ব সুজনকাঠী গ্রামের হতদরিদ্র ভ্যান ও রিকসা চালক, চায়ের দোকানদারসহ শতাধিক দিনমজুর পরিবারের মাঝে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বিতরন করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের সংকটময় মুহুর্তে গৌরনদী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম ছরোয়ারের উদ্যোগে থানা পুলিশ সদস্যদের বেতনের টাকায় কর্মহীন দুই শতাধিক পরিবারের মাঝে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

গত ২৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার গুজবে উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের পীরেরপাড় এলাকার রাস্তার পাশে পরেছিলো মানসিক ভারসাম্যহীন ৬০ বছরের অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহ। করোনা আতঙ্কের গুজবে অজ্ঞাত পরিচয়ধারী মুসলিম ওই ব্যক্তির মরদেহের দাফনের জন্য যখন কেউ এগিয়ে আসেননি। খবর পেয়ে থানা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বে ঘটনাস্থলে ছুটে যান উজিরপুর মডেল থানার ওসি জিয়াউল আহসান। ওসি তার নিজের টাকায় ওই ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন।

একইভাবে গত ১৮ এপ্রিল নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আমবাগান এলাকায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যায় ১৮ মাস বয়সী এক শিশু। নিজ ঘরে শিশুটির মৃত্যুর খবরে পাড়া-প্রতিবেশী কেউ এগিয়ে আসেনি। বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তিনি তার শিশু পুত্রের লাশ নিয়ে পরেন বিপাকে। আশপাশের বাসিন্দাদের কাছে আকুতি মিনতি করলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। উপায়অন্তুর না পেয়ে প্রতিবন্ধী পিতা বাসার বাইরে অবস্থান নিয়ে কাঁদতেছিলেন। এমন সময় কোতয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ নুরুল ইসলাম পিপিএম’র নির্দেশে মৃত্যুর ছয় ঘন্টা পর থানা পুলিশ শিশুর লাশের গোসল করিয়ে জানাজা শেষে দাফন করেন।

অপরদিকে প্রাণঘাতী মহামারী করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে রিকশা চালক ও সাধারণ পথচারীদের মাঝে মাক্স বিতরন করেছেন উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মোঃ জাকির হোসেন মজুমদার, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) জাকারিয়া রহমান জিকু, সহকারী কমিশনার ট্রাফিক (দক্ষিণ) মাসুদ রানা, সহকারী কমিশনার (উত্তর) একেএম ফয়েজুর রহমান, টিআই আব্দুর রহিম, বিদ্যুত চন্দ্র দে,সার্জেন্ট রানা ও হাসান।

এদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হওয়া ব্যক্তিদের দাফন কার্য সম্পাদনের জন্য ১৭ শতক জমি দান করে মানবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন জেলার বানারীপাড়া থানায় কর্মরত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) জাহিদুল ইসলাম জাহিদ। এএসআই জাহিদুল ইসলাম এর আগে বানারীপাড়ায় করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতিরোধে লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টিনে থাকায় কর্মহীন হয়ে পরা হতদরিদ্রদের মাঝে নিজের বেতনের টাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী এবং শিশুসহ কর্মহীনদের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ ও খেলার সামগ্রী বিতরণ করেছেন।

জানা গেছে, জেলা পুলিশ সুপারের উদ্যোগে ইতোমধ্যে জেলার দশটি থানার প্রত্যেকটিতে শতাধিক পরিবারের মাঝে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। সূত্রমতে, গোটা বরিশালজুড়ে লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টিন সফল করা থেকে শুরু করে আত্মসাত করা ত্রাণের চাল উদ্ধারেও কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। ইতোমধ্যে বরিশালের এক পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাই দিন রাত একাকার করে কাজ করা পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও করোনা আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে অধিকাংশ থানার পুলিশ সদস্যদের যারা মাঠে কাজ করেন, তাদের নিজ নিজ পরিবার থেকে আলাদা রেখে অফিস কোয়ারেন্টিনে থেকে কাজ করতে হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে, এতো বড় সংকট পূর্ণ মুহুর্তে নিজের জীবন বাঁজি রেখে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন পুলিশ সদসদ্যরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কখনও পলায়নকৃত করোনা রোগীকে ধরে আনা, করোনা আক্রান্তের বাসা, ভবন ও এলাকা লকডাউন করা, ত্রাণ বিতরণসহ নানা কাজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা।

সূত্রমতে, পুলিশের সুরক্ষার বিষয়ে এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণ সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা হয়নি। এতে ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরী হয়ে পরেছে। সচেতন বরিশালবাসীর মতে, বিশ্বের এমন পরিস্থিতি একসময় বদলে যাবে। বদলে যাবে বাংলাদেশও। শুধু মানুষের চাওয়া করোনার বিপদ কেটে যাওয়ার পরেও পুলিশের এ ভাবমুর্তি যেন অক্ষুন্ন থাকে।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by