শিক্ষা

❝একজন শিক্ষকের হাতে বহু মানবসম্পদ❞

  প্রতিনিধি ২৭ মার্চ ২০২৪ , ৫:৪২:৩৫ প্রিন্ট সংস্করণ

❝একজন শিক্ষকের হাতে বহু মানবসম্পদ❞

১০৪° জ্বর নিয়ে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীর সামনে হাসতে পারে। পায়ে ব্যথা নিয়ে বাড়িতে যন্ত্রণায় থেকে ক্লাসে এসে মুচকি হেসে ক্লাস শুরু করতে পারে। মাথার ফিনফিন ব্যথা নিয়ে সূত্র মিলিয়ে পাঠদান করাতে পারে। পরিবার পরিজন রেখে শ্রেণীতে ঢুকে আর একটা পরিবার গঠন করতে জানে। নিজের স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হলেও লুথারের ❝I have a Dream❞ পড়াতে পারে।

নিজে বিরহের উত্তপ্ত আগুনে জ্বলেও বাইরনের ❝She Walks in Beauty❞ আলোচনা করতে পারে। নিজের পকেটে কাবাডি চললেও ❝How to Waste/Save Money❞ আলোকপাত করতে পারে। নিজের জীবনে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে টেনিসনের ❝The Charge of the Light Brigade❞ আবৃত্তি করতে পারে।

নিজে মৃত্যুর উপত্যকায় রয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা নিয়ে লেখা ডাব্লিউ এইচ অডেনের ❝September 1, 1939❞ নিয়ে কথা বলতে পারে। নিজে বন্ধু হারিয়ে শেক্সপিয়ারের ❝Love and Friendship❞ বুঝিয়ে দিতে পারে। নিজে বহু কুৎসিত হয়ে এমিলি ডিকিনসনের ❝I Died for Beauty❞ ও লিজি’র ❝Lizi’s Beautiful❞ সুন্দর করে ভূমিকা দিতে পারে। সহস্র দুঃখ নিয়ে সেমুয়েল টেইলর কলরিজের ❝Kubla Khan❞ সুললিত ব্যাখ্যা করতে পারে।

তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ❝The Dairy of a Young Girl❞ পড়াইতে জানে। নিজে ৩৬৫ দিন পঙ্গু বিকলাঙ্গ অজস্র বেদনায় থেকে জন রীডের ❝Ten Days Shook the World❞ এ মজা খুঁজতে জানে। শত অপমান সহৃ করে রাইডার হ্যাগার্ডের ❝She❞ নিয়ে তুমুল বর্ণনা করতে জানে। পরিবারের অহরহ ঝামেলায় থেকে রবার্ট ফ্রষ্টের ❝Out’ Out❞ নিয়ে নিউ ইংল্যান্ড ও কানাডার সীমান্তবর্তীর দিব্যি পাহাড় দেখতে পারে।

জরাজীর্ণ জায়গায় বসবাস করে হার্পার লী’র ❝To kill a Mockingbird❞ নীরবে পড়াতে পারে। স্ব-স্ব বিস্তারিত অজনা অচেনা অদেখা টপিক নিয়ে কথা বলতে বলতে শিক্ষার্থীদের মজা দিতে জানে। শিক্ষকরা অনেক কিছু আড়াল করতে পারে মিথ্যা হাসির অন্তরালে! নিজের সহস্র কষ্ট ভুলে গিয়ে স্টুডেন্টকে সাত আসমান ঘুরিয়ে আনতে পারে। প্রসান্ত, এভারেস্ট ও আমাজন ভ্রমণে নিঃশেষে বিভাজ্য করতে পারে।

তবে আমরা কী কখনো এমন প্রশ্ন করেছি? স্যার আপনার শরীর কেমন? আপনার মন ভালো? বাড়িতে সবাই সুস্থ ও ভালো আছে? সকালে নাশতা হয়েছে কী স্যার? আপনার জায়গা-জমি নিয়ে সমস্যাটা সমাধান হয়েছে? আপনার দিনকাল সুন্দর যাচ্ছে? স্যার আজ কী আমাদের সাথে দুপুরে এক সাথে খাওয়া যাবে? স্যার রাতে কি এক সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে? আপনার না বলা কথা গুলো আমাদের বলা যাবে? আপনি কীভাবে এতদূর এসেছেন আমাদের শুনাবেন? আপনার অনুপ্রেরণা কী কী কারা ছিল? আপনি কী আমাদের মন খুলে বলতে পারবেন?

আমরা কিছু শিখতে পারবো না আপনার জীবন থেকে? না বলিনি এমন কখনো! স্যার আমাদের আপনার কাছের মনে করে সব কিছু বলতে পারবেন। আমরা আপনারই সন্তান, ভাই, বোন ও পরিবার। আমাদের মানুষ করার জন্য আপনার ছেলেমেয়েকে আদর করতে পারছেন না। আমরা আপনার সন্তান-সন্ততি। দিনের বেশিরভাগই সময় আমাদের উজাড় করে দিচ্ছেন। আমাদেরকে দেশের দক্ষ মানব সম্পদে তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছেন।

বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলকনিতে হাঁটতে পারার সুযোগ করে দিচ্ছেন। ভিন দেশে হায়ার এডুকেশন করতে তৎপর করছেন। জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারার ক্ষমতা করে দিচ্ছেন। আপনিইতো জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ স্যার। আপনিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মনের মানুষ স্যার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক, খ, গ, ঘ পড়িয়েছেন। মকতবে আলিফ-বা পড়িয়েছেন। মন্দিরে জ্ঞান দিয়েছেন। ধর্মীয় এলমে পরিপূর্ণ করেছেন আমাদের। মাধ্যমিকে দুনিয়াকে চিনাইতে কত কিছু করেছেন। নিজের সন্তানের মতো আদরযত্ন করেছেন। উচ্চ-মাধ্যমিকে জীবনকে কীভাবে সাজানো যায় তা নিয়ে কথা বলেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের জন্য, পরিবারের জন্য এবং প্রতিবেশীর জন্য যোগ্য মানব হতে জনসম্পদে রুপান্তর করেছেন। কই আমরাতো কখনো আপনার থেকে খোঁজিনি। চেপে ধরে বলিনি এটা করান ওইটা করান। তবুও আপনি নিজের মতো করে মানুষ করেছেন। নিজের ছেলেমেয়ের মতো আঁকড়ে রেখেছেন। কখনো শাসন করে, কখনো বকা দিয়ে ও কখনো বেতের আঘাত করে। শিক্ষক-শিক্ষিকা একমাত্র শ্রেণি যারা অপরের সন্তানের উন্নতিতে হাসে। অপরের অগ্রগতিতে হাত তালি দেয়। অনেক বছর পরে দেখা হলে ভালো কিছু করে বললে বুকে টেনে নেয়।

চোখের কোনা মুছতে মুছতে বলে অনেক গর্ব হয় তোদের নিয়ে। বেঁচে থাক বাবা। দোয়া করিস। আমাদের স্যাররা তীব্র শীতে, উত্তপ্ত রোদে, পথঘাট ডোবা বৃষ্টিতে ও অস্পষ্ট কুয়াশায় ক্লাসে চলে আসতেন। ক্লাসে এসে সকলের খবর নিতেন। সবার বাড়ি-ঘরের অবস্থা জেনে নিতেন। কতশত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আমাদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। আমাদের জীবনকে উপভোগ করতে সাহায্য করেছেন। সবুজ গ্রহে টিকিয়ে রাখতে ও থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

আমরা তাঁদের কতটুকু মনে রাখি? শেষ বয়সে কয়বার স্মরণ করে দেখা করি? কখনো কী জানতে চেয়েছি সেই স্যার কোথায় আছেন? যিনি দুষ্টুমির কারণে বেত্রাঘাত করে পরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বকা দিয়ে পরে আদর করতেন। বেয়াদবি করলে শিক্ষা দিতেন। পিটিতে সুশৃঙ্খল থাকতে মার দিতেন। যেই শৃঙ্খলার কারণে আজ আমরা প্রশাসনের হেড হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি। দেশের মানুষের পাশে থাকতে পেরেছি। দুনিয়ার বড় বড় পদবি ওয়ালারা কোনো না কোনো শিক্ষকের হাত ধরেই এতদূর এসেছেন।

যতবড় পদবি থাকুক না কেন? নিশ্চয়ই শিক্ষকের অমায়িক শিক্ষার কারণে আজ মস্ত বড় দায়িত্ব নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কলম নাচাচ্ছেন। ক্যামেরার সামনে ঘুচিয়ে কথা বলছেন। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। কাগজ-পত্রিকায় শিরোনাম হিসেবে আসছেন। বড় অনুষ্ঠানের প্রধান মেহমান হচ্ছেন। সবকিছু সেই শিক্ষক-শিক্ষিকা নামের বাবা-মায়ের জন্য।

সেই বড় ভাই ও আপু নামের শিক্ষক শিক্ষিকার জন্য। তাঁদের মনে রাখুন। তাঁদের সাথে যোগাযোগ করুন। তাঁদের পাশে থাকুন। তাঁদের খোঁজ রাখুন। শেষ বয়সে হয়ত চেয়ারে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে বলছে, হে-হে! সে আমার ছাত্র। আমি পড়িয়েছি তাকে। খুব দুষ্ট ছিল। কিন্তু আজ দেশের রাষ্ট্রপতি! দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের সেনা প্রধান! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন! বড় কোম্পানির প্রধান! এসব বলে চোখের কোনা মুছছে।

একবার কী ভেবেছেন কেমন খুশি হবেন তিনি যদি আপনি আমি গিয়ে পায়ে ধরে সালাম করে হাসিমুখে বলি, ❝স্যার আপনার সেই দুষ্ট ছাত্র দেশের সেনা প্রধান। আপনার সেই স্কুল ফাঁকি মারা শয়তান দেশের রাষ্ট্রপতি। আপনাকে বকবক করে বিরক্ত করা সেই পাজি এখন কোর্টের জাজ!❞ বেঁচে থাকুক সহস্র বছর আমাদের শিক্ষা গুরুরা।

শান্তিতে থাকুক জীবনের অধিকাংশ সময় অপরের তরে কাটিয়ে দেওয়া শিক্ষক শিক্ষিকারা। মহান অধিপতি তাঁদের সহস্র বছর জিইয়ে রাখুক ভুবনে।

ওমর ফারুক 

ইংরেজি বিভাগ

সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by