তথ্যপ্রযুক্তি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: চাকরির বাজারে ঝুঁকি ও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

  প্রতিনিধি ১৩ অক্টোবর ২০২৫ , ৫:৫১:৫৭ প্রিন্ট সংস্করণ

মোঃ রেজাউল করিম রাজু :  চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এখন আর কোনো কল্পবিজ্ঞানের বিষয় নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং, বিপণন—সবকিছুতেই এর পদচারণা। প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রা একদিকে যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলছে, তেমনই বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এর ফলে কিছু প্রচলিত চাকরি যেমন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ, যার জন্য প্রয়োজন পড়ছে সম্পূর্ণ নতুন সব দক্ষতার।

ঝুঁকি এবং বদলে যাওয়া কাজের ধরণ : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত মানুষের মতো করে চিন্তা ও কাজ করতে সক্ষম একটি কম্পিউটার সিস্টেম। এর প্রধান কাজ হলো বিপুল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। যে কাজগুলো পুনরাবৃত্তিমূলক (Repetitive) ও নিয়মভিত্তিক, যেমন—ডেটা এন্ট্রি, গ্রাহক সেবা, কারখানার সাধারণ শ্রমিকের কাজ, হিসাবরক্ষণ ইত্যাদি—সেগুলো এআই এবং অটোমেশনের মাধ্যমে খুব সহজেই সম্পন্ন করা যায়।

বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব ইতোমধ্যে স্পষ্ট। গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেনারেটিভ এআই-এর প্রভাবে শুধু ইউরোপ ও আমেরিকাতেই প্রায় ৩০ কোটি মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে।একইভাবে, বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক “সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রায় ৭ শতাংশ চাকরি সরাসরি এআই-এর কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে, যদিও ১৫ শতাংশ চাকরিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এই খাতে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে বহুসংখ্যক শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই নারী, তাদের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়তে পারে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক, আসবাবপত্র, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, পর্যটন ও চামড়া খাতে প্রায় ৫৩ লক্ষাধিক চাকরি অটোমেশনের কারণে ঝুঁকিতে পড়বে, যার মধ্যে শুধু পোশাক খাতেই প্রায় ২৭ লাখ। এছাড়াও, ব্যাংকিং খাতে এআই-ভিত্তিক জালিয়াতি শনাক্তকরণ, টেলিকম খাতে গ্রাহকসেবায় চ্যাটবটের ব্যবহার এবং আইটি খাতে সাধারণ প্রশাসনিক কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাওয়ায় প্রচলিত চাকরির সুযোগ কমছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চাকরির বাজারের জন্য কোনো হুমকি নয়, বরং এটি একটি নতুন যুগের সূচনা। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে পিছিয়ে পড়তে হবে, আর মানিয়ে নিতে পারলে খুলে যাবে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। তাই ভয় না পেয়ে, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নতুন দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে আমাদের আগামীর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও নীতিগত সমর্থনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সুফল ভোগ করতে পারবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াবে।

নতুন দক্ষতার প্রয়োজন ও উদীয়মান খাত : তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদিকে যেমন ঝুঁকি তৈরি করছে, তেমনি অন্যদিকে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (WEF) তথ্য অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮.৩ কোটি চাকরি বিলুপ্ত হলেও নতুন করে তৈরি হবে প্রায় ৬.৯ কোটি কর্মসংস্থান। এর মানে হলো, চাকরির বাজার সংকুচিত হচ্ছে না, বরং এর ধরন বদলে যাচ্ছে।

এখন সেইসব পদের চাহিদা বাড়ছে যেগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিস্টেম তৈরি, পরিচালনা এবং উন্নয়নের সাথে জড়িত। যেমন:

ডেটা সায়েন্টিস্ট ও অ্যানালিস্ট: ডেটা বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা।

মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার: এআই মডেল তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া।

এআই এথিক্স স্পেশালিস্ট: এআই-এর নৈতিক ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে কাজ করা।

রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ার: শিল্প ও অন্যান্য খাতের জন্য রোবট ডিজাইন ও পরিচালনা করা।

এই নতুন পদগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজন হবে কিছু মানবিক দক্ষতা (Soft Skills)। এর মধ্যে রয়েছে—সমস্যা সমাধান, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking), সৃজনশীলতা এবং আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence)। কারণ, যন্ত্র মানুষের কাজকে স্বয়ংক্রিয় করতে পারলেও সৃজনশীলতা ও মানবিক বিচার-বিবেচনার জায়গাটি এখনও মানুষের দখলেই রয়েছে।

সাম্প্রতিক অবস্থা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি : বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপ ডেটা অ্যানালিটিক্স, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ই-কমার্সে এআই-এর ব্যবহার করছে। আশার কথা হলো, সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা তরুণদের ডিজিটাল ও এআই দক্ষতায় পারদর্শী করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যারা এআই-সম্পর্কিত দক্ষতা অর্জন করেছেন, তারা অন্যদের চেয়ে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি মজুরি পাচ্ছেন।

তবে আমাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। দেশের বিপুল সংখ্যক কর্মীর এখনও প্রযুক্তিনির্ভর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই। ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স ও রোবোটিকসের মতো বিষয়গুলোকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : ভবিষ্যতে চাকরির বাজারে মানুষের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক ধরনের মেলবন্ধন তৈরি হবে। এআই পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো করে দেবে, আর মানুষ মনোযোগ দেবে কৌশলগত ও সৃজনশীল কাজে। স্বাস্থ্যসেবায় রোগ নির্ণয়, কৃষিক্ষেত্রে ফসলের পূর্বাভাস এবং ফিনটেক (FinTech) খাতে আর্থিক লেনদেন আরও সহজ ও নিরাপদ করতে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ যদি এই প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, তবে এটি কেবল কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি না করে, বরং নতুন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।

আরও খবর

Sponsered content