তথ্যপ্রযুক্তি

সাইবার জগৎ – আমাদের ডিজিটাল ঘর কি আসলেই নিরাপদ?

  প্রতিনিধি ২৭ অক্টোবর ২০২৫ , ৬:২১:৪৮ প্রিন্ট সংস্করণ

কোটি কোটি নাগরিকের তথ্য ফাঁস, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং ডিজিটাল প্রতারণার ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত?

মোঃ রেজাউল করিম রাজু :  এক সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি শোনেন আপনার নাম, ফোন নম্বর, এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো সব গোপন তথ্য এখন অনলাইনে চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে, কেমন লাগবে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঠিক এটাই ঘটেছে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের সাথে। এটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা ছিল না; ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাদের নাজুক নিরাপত্তার এক ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি।

আমাদের জীবনটা এখন ডিজিটাল ভল্টে বন্দি, কিন্তু সেই ভল্টের চাবিটা যে কতটা দুর্বল, এই একটা ঘটনাই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আর প্রাচীর ভাঙার পরের পরিণতি তো ভয়াবহ হতেই বাধ্য। সাইবার নিরাপত্তা তাই এখন আর কোনো জটিল টেকনিক্যাল বিষয় নয়, এটা আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষের ডিজিটাল বেঁচে থাকার লড়াই।

সাইবার নিরাপত্তা কী: সাইবার সিকিউরিটি হলো ডিজিটাল সম্পদ, যেমন কম্পিউটার, সার্ভার, মোবাইল ডিভাইস, নেটওয়ার্ক এবং ডেটাকে বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য গৃহীত প্রযুক্তি, প্রক্রিয়া এবং অভ্যাসের সম্মিলিত রূপ। এর দর্শনকে একটি আধুনিক দুর্গের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেখানে একাধিক স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে:

  • প্রযুক্তিগত স্তর : ফায়ারওয়াল, অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার, ডেটা এনক্রিপশন।
  • প্রশাসনিক স্তর : নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন, কর্মীদের প্রশিক্ষণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা।
  • ভৌত স্তর : ডেটা সেন্টারের ভৌত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

এই তিন স্তরের সমন্বয়েই একটি শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে ওঠে, যার লক্ষ্য কেবল আক্রমণ ঠেকানো নয়, বরং হামলা সংঘটিত হলে দ্রুত শনাক্ত করে ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্ন করা।

যেভাবে বদলে গেছে আক্রমণের ধরন

হ্যাকাররা এখন আরও স্মার্ট। তাদের হাতে রয়েছে AI-এর মতো শক্তিশালী টুল। আক্রমণের ধরনগুলোও তাই বদলে গেছে।

১. ডিপফেক ও ভয়েস ক্লোনিং: এটি এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। অপরাধীরা এখন যেকোনো ব্যক্তির ছবি বা কণ্ঠস্বরের ছোট নমুনা ব্যবহার করে তার মতো কথা বলা বা ভিডিও তৈরি করতে পারে। এটিকে ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণা থেকে শুরু করে সামাজিক সম্মানহানি, সবকিছুই করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এই ধরনের প্রতারণার অভিযোগ বাড়ছে।

২. AI-চালিত ফিশিং : আগে ফিশিং ই-মেইল বা মেসেজে বানান ভুল বা ভাষার অসংলগ্নতা দেখে সন্দেহ করা যেত। কিন্তু এখন AI ব্যবহার করে অপরাধীরা এতটাই নিখুঁত এবং বিশ্বাসযোগ্য ভাষায় বার্তা তৈরি করছে যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা ধরা প্রায় অসম্ভব। আপনার অফিসের বসের নামে বা ব্যাংকের তরফ থেকে এমনভাবে ই-মেইল আসবে, যা দেখে সন্দেহ করার কোনো উপায়ই থাকবে না।

৩. জিরো-ডে অ্যাটাক : সফটওয়্যারের এমন কোনো অজানা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হামলা করা, যা স্বয়ং নির্মাতাও জানেন না। ২০২৪ সালে এই ধরনের হামলার সংখ্যা বেড়েছে। হ্যাকাররা দ্রুত এসব দুর্বলতা খুঁজে বের করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করছে।

৪. গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা: হ্যাকারদের লক্ষ্য এখন আর শুধু ব্যক্তিগত তথ্য চুরি নয়। তারা এখন দেশের বিদ্যুৎ গ্রিড, ব্যাংক, বিমানবন্দর, এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে (Critical Infrastructure) টার্গেট করছে। ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতেও সাইবার হামলার আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করা হয়েছিল, যা এর বাস্তব উদাহরণ।

২০২৪-২০২৫ এর চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

  • সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর প্রয়োগ: নতুন আইন কার্যকর হলেও এর বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সাধারণ মানুষ কতটা সুরক্ষা পাচ্ছে বা অপরাধীরা কতটা শাস্তির আওতায় আসছে, তা ২০২৫ সালে একটি বড় প্রশ্ন।
  • দক্ষ জনবলের তীব্র সংকট: AI-ভিত্তিক আক্রমণ ঠেকাতে যে মানের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, আমাদের দেশে সেই সংখ্যা এখনও অনেক কম। ফলে বিদেশি হ্যাকারদের sofisticated আক্রমণের সামনে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায়ই দুর্বল প্রমাণিত হচ্ছে।
  • ডিজিটাল লিটারেসির অভাব: স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও ডিজিটাল স্বাক্ষরতা সেই হারে বাড়েনি। ডিপফেকের মতো বিষয় সম্পর্কে দেশের সিংহভাগ মানুষই অবগত নন, যা তাদের সহজ টার্গেটে পরিণত করছে।

২০২৬ কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?

  • AI বনাম AI-এর লড়াই: ২০২৬ সালে সাইবার নিরাপত্তা পুরোপুরি AI-নির্ভর হয়ে যাবে। একদিকে থাকবে আক্রমণকারী AI, অন্যদিকে থাকবে প্রতিরক্ষাকারী AI। এই প্রযুক্তিগত লড়াইয়ে যে এগিয়ে থাকবে, সেই ডিজিটাল বিশ্বে নিয়ন্ত্রণ করবে।
  • ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) ঝুঁকি: আপনার স্মার্ট টিভি, ফ্রিজ, এসি থেকে শুরু করে স্মার্ট গাড়ি—সবকিছুই ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত। ২০২৬ সাল নাগাদ এই ডিভাইসগুলো হ্যাকারদের নতুন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। একটি অনিরাপদ স্মার্ট বাল্বও আপনার পুরো বাড়ির নেটওয়ার্ককে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে।
  • কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর হুমকি: যদিও এটি এখনও কিছুটা দূরে, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার যখন সহজলভ্য হবে, তখন বর্তমানের সবচেয়ে শক্তিশালী এনক্রিপশনও মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে। এর জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

বাংলাদেশে প্রচলিত সাইবার আক্রমণ : সাইবার অপরাধীরা প্রযুক্তিগত দক্ষতার চেয়েও বেশি ব্যবহার করে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা, যেমন—ভয়, লোভ এবং বিশ্বাস। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত কয়েকটি আক্রমণের ধরন নিচে তুলে ধরা হলো:

১. প্রতারণার ডিজিটাল টোপ : এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকর কৌশল। অপরাধীরা ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থার ছদ্মবেশে ই-মেইল (ফিশিং) বা ফোন কল (ভিশিং) করে ব্যবহারকারীর সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নেয়।

  • বাস্তব উদাহরণ: সম্প্রতি “নগদ বা বিকাশের কাস্টমার কেয়ার কর্মকর্তা” পরিচয়ে ফোন করে অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশনের নামে পিন বা ওটিপি (OTP) চেয়ে নেওয়ার ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (CCA Foundation) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে অনলাইন আর্থিক প্রতারণার শিকার হওয়াদের মধ্যে সিংহভাগই এই ধরনের ফাঁদে পা দেন।

২. ডিজিটাল মুক্তিপণ : র‍্যানসমওয়্যার হলো একটি ক্ষতিকর সফটওয়্যার, যা আপনার ডিভাইসের সমস্ত ফাইলকে শক্তিশালী এনক্রিপশন ব্যবহার করে লক করে দেয়। ফাইলগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য অপরাধীরা বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সিতে মুক্তিপণ দাবি করে।

  • বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিয়াল পাইপলাইনে র‍্যানসমওয়্যার হামলার কারণে দেশটির পূর্বাঞ্চলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। বাংলাদেশে বড় আকারের প্রাতিষ্ঠানিক র‍্যানসমওয়্যার হামলার ঘটনা এখনো কম হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই এর শিকার হচ্ছেন।

৩. নীরব ঘাতক: ম্যালওয়্যার হলো যেকোনো ধরনের ক্ষতিকর সফটওয়্যারের সাধারণ নাম। এর মধ্যে ট্রোজান হর্স (বৈধ সফটওয়্যারের ছদ্মবেশে আসে) এবং স্পাইওয়্যার (ব্যবহারকারীর অজান্তে তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে) সবচেয়ে বিপজ্জনক। অনিরাপদ অ্যাপ, পাইরেটেড সফটওয়্যার বা সন্দেহজনক ওয়েবসাইট থেকে এগুলো ডিভাইসে প্রবেশ করে।

৪. ডিডস (DDoS Attack) : ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়াল-অব-সার্ভিস (DDoS) আক্রমণের লক্ষ্য হলো কোনো ওয়েবসাইট বা অনলাইন সার্ভিসে একসঙ্গে হাজার হাজার ভুয়া অনুরোধ পাঠিয়ে তাকে অচল করে দেওয়া। এর ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীরা আর সেই পরিষেবা ব্যবহার করতে পারেন না।

  • বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট: সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক, সরকারি ওয়েবসাইট এবং গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে DDoS হামলার চেষ্টা করা হয়েছে, যা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার : সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুক্তভোগীদের মধ্যে হয়রানির শিকার হন প্রায় ৮.৮৫ শতাংশ নারী এবং ভুয়া তথ্য বা গুজবের শিকার হন প্রায় ৭.৬৭ শতাংশ ব্যবহারকারী। আশঙ্কার বিষয় হলো, অপরাধের শিকার হয়েও মাত্র ১২ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনি ব্যবস্থা নেন, যার মূল কারণ সচেতনতার অভাব এবং সামাজিক জড়তা।

  • প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ফাঁস এবং সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফেসবুক পেজে সাইবার হামলার মতো ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে আমাদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো (Critical Information Infrastructure) এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

এই নতুন প্রজন্মের সাইবার যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে আমাদের প্রয়োজন একদল দক্ষ “সাইবার যোদ্ধা”। এথিক্যাল হ্যাকিং, ডিজিটাল ফরেনসিক্স এবং থ্রেট ইন্টেলিজেন্সে পারদর্শী জনশক্তি তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

আরও খবর

Sponsered content