ঢাকা

‘ওয়েসিস’ মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মিলছে আন্তর্জাতিক মানের সেবা

  প্রতিনিধি ২২ জানুয়ারি ২০২৪ , ৪:৩৮:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

'ওয়েসিস' মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মিলছে আন্তর্জাতিক মানের সেবা

তানভীর হাসান (ছদ্মনাম)। অত্যন্ত মেধাবী এই শিক্ষার্থী চিকিৎসা বিদ্যায় পড়া-লেখার সুযোগ পান দেশের স্বনামধন্য একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে। সেখানে ভর্তির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পড়াশোনায় অমনোযোগী ও প্রেমঘটিত কারণে প্রথমবর্ষেই তার রেজাল্ট খারাপ হয়। এ নিয়ে মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকা তানভীর হাসান বিষয়গুলো শেয়ার করেন সহপাঠীদের সঙ্গে। তারা প্রথমে গাঁজা সেবনে উৎসাহ দেন তাকে। আস্তে আস্তে তানভীর হয়ে ওঠে ভয়াবহ মাদকসেবী। একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রেমের সম্পর্ক; মেডিকেল কলেজ থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয়। মাদকের নেশায় এতোটাই হীন হয়ে যান যে, মাদকের টাকা জোগাড়ে তিনি একসময় মাদককারবারে জড়িয়ে পড়েন।

তানভীরের চেয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা সোহেল রানার (ছদ্মনাম)। তরুণ বয়সে পড়াশোনার পাশাপাশি গড়ে তোলেন গরুর খামার। খুব স্বল্প সময়ে সফলতাও পান তিনি। প্রতিদিন নগদ টাকা আসতে থাকে; এরপর নামেন ইজারা ব্যবসায়। স্থানীয় সিনিয়রদের মাধ্যমে প্রথমে ফেনসিডিল সেবন শুরু করেন। এরপর হেরোইন। তার পরিবর্তন দেখে পরিবার বিয়ে দিয়ে দেয়। দুই সন্তান থাকলেও তাদের দেখভালে বা সংসারের প্রতি তার কোনো মনোযোগ ছিলো না। ওদিকে ব্যবসায়ও ধ্বংস নামতে থাকে। দীর্ঘ একযুগ পর সোহেল বুঝতে পারেন তার সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পর নিজেই ভর্তি হন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে এখন আক্ষেপ করেন সোহেল। তানভীর ও সোহেল চিকিৎসা নেন বাংলাদেশ পুলিশের উদ্যোগে নির্মিত ওয়েসিস মাদক নিরাময়, পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্রে। মাদকের অন্ধকার জগতে পা বাড়ানো মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে আড়াই বছর আগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার প্রায় আড়াই বছরে এমন অনেক গল্পের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ‘ওয়েসিস’।

‘ওয়েসিস’ এর বাংলা হলো মরূদ্যান, অর্থাৎ রুক্ষ বৃক্ষহীন মরুভূমিতে এক টুকরো সবুজ। দেশে যখন মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসন- এ নাজুক অবস্থা, তখন ঊষর মরুভূমির মধ্যে সবুজ আর বারিবিন্দু নিয়ে মাদকাসক্তদের সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

২০২১ সালের অক্টোবর মাসে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়েসিস’। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক পরিবেশে উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি। এখানকার চিকিৎসা পদ্ধতি, পরিবেশ এবং সবার আন্তরিকতা খুবই চমৎকার।

বর্তমানে ওয়েসিসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)। প্রতিষ্ঠানটি থেকে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিকের বেশি মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।

ওয়েসিসে চিকিৎসা নেওয়া তানভীরের পরিবার আমাদের প্রতিনিধিকে বলেছিলো, তারা যখন বুঝতে পারেন তানভীর কঠিনভাবে মাদকে জড়িয়ে পড়েছে তখন একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে সে পুনরায় মাদক সেবন ও বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে একাধিক নিরাময় কেন্দ্রে তাকে চিকিৎসা করানো হলেও কোনো সুফল পাননি তারা। সর্বশেষ তাকে ওয়েসিসে ভর্তি করানো হয়। ফয়সাল নিজেও আমাদের প্রতিনিধিকে বলছিলেন, ‘এবার সে অতীতে করে আসা সব ভুল বুঝতে পারছেন। এখানে ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন, হাদিসের বই পড়েন, জিম করেন, বিকালে ছাদে হাঁটাহাটি করেন। তাছাড়া ওয়েসিসের খাবারের মানও অনেক উন্নত। যার ফলে তার কাছে মনে হয়, তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই বসবাস করছেন।’

প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকেই এখানে কাজ করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোর্তজা হাসান। আমাদেরকে তিনি বলেন, ‘এখানে যেসব রোগী আসেন তাদের বেশির ভাগ হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদকে আসক্ত। এক্ষেত্রে প্রকারভেদে তাদের বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে ইয়াবা আসক্ত রোগী বেশি জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘ইয়াবা বহন করা সহজ। একারণে এই নেশায় বেশি মানুষ আসক্ত হয়। এরপরেই গাঁজাসেবীর সংখ্যা। এটার কারণ খরচ কম, ইয়াবার মতো বহনও সহজ।’

বর্তমানে ওয়েসিসের সক্ষমতা কতটুকুঃ

——————————————

জানতে চাইলে মোর্তজা হাসান বলেন, ‘অন্যান্য হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্র যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে আমরা তার থেকে আরও বেশি কিছু দিতে পারবো। এক্ষেত্রে আমরা দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়েসিসকে তুলনা করতে পারি। কারণ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সাইক্রেটিস্টরা অনকলে বা সপ্তাহে একবার রোগী দেখেন। কিন্তু আমরা প্রতিদিন রোগী দেখি। যদি রাতে নাও থাকি অন্যান্য চিকিৎসাকরা বিষয়টি জানালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিয়ে আসা অনেকে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারাই বলেছেন- সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আর এখানকার চিকিৎসা পুরোপুরি ব্যতিক্রম।’

সরেজমিনে ওসেসিসে ঘুরে দেখা গেছে, ৭তলা ভবনের নিচতলায় নিরাপত্তাকর্মীদের কক্ষ। যেখানে পুলিশ সদস্যরা শিফট ভেদে ডিউটি করেন। এর পাশেই আউটডোরে রোগী দেখার রুম রয়েছে। পাশেই নিজস্ব রান্না ঘর। সেখানেই প্রতিবেলায় রোগীদের রান্নার কাজ চলে।

ভবনের ১ তলা থেকে ৩ তলা পর্যন্ত মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আবাসিক ব্যবস্থায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ভবনটিতে রয়েছে সর্বাধুনিক প্যাথলজি ল্যাব। এসি ফ্লোর, জেনারেল বেডের ওয়ার্ড, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা, বিশেষ কেবিন ও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা। শুধু খেলাধুলাই নয়, পড়ালেখার জন্য লাইব্রেরীর সুব্যবস্থাও আছে এখানে।

এছাড়াও রয়েছে নার্সিং স্টেশন। এর ঠিক ওপরেই গড়ে তোলা হয়েছে সুসজ্জিত বাগান। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগীদের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বাগানে।

ছাদবাগানের পাশেই রয়েছে ব্যায়ামাগার। অর্থাৎ মাদকাসক্তদের পরিপূর্ণ সেবা দিতে সরকারের সব বিধিমালা মেনেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘ওয়েসিস’ নামক প্রতিষ্ঠানটি। এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ইয়োগা এক্সপার্ট এবং অভিজ্ঞ অ্যাডিকশন কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।

প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ পরিদর্শক সুশান্ত নারায়ণ দে। আমাদেরকে তিনি বলেন, ‘পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা দেখি মাদকাসক্ত নিরাময়ের নামে রোগীদের আটকে রাখা, নির্যাতন করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের প্রধান লক্ষ্য রোগীদের সেবা দেওয়া। আন্তজার্তিক মানদণ্ড অনুযায়ী একজন রোগীর জন্য যা যা দরকার সবই এখানে আছে। অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান স্যার সরাসরি এটা তদারকি করেন। এখানে কোনো কিছুর ব্যত্যয় যাতে না হয় সেক্ষেত্রে তিনি খুবই কঠোর।’

সুশান্ত বলেন, আমাদের এখানে বাইরের খাবারের অনুমোদন নেই। টাটকা খাবার এখানেই রান্না করা হয়; যা রোগী ও স্টাফ মিলে প্রতিবেলায় প্রায় ৭০ জনের।

ওয়েসিসের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকাসক্ত সব রোগীই এখানে চিকিৎসা নিতে পারেন। যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের সবসময় কাউন্সিলিং করা হয়। কেন মাদকে জড়ালেন, তাকে যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে সব ঠিক মতো কাজ করছে কি না এসব বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। ৪ মাস চিকিৎসা শেষে কেউ ফিরে গেলেই ওয়েসিসের কাজ শেষ হয়ে যায় না। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তারা ওয়েসিসে এলে বিনামূল্যে ফলোআপ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। ফলোআপে যদি আমাদের সন্দেহ হয় তাহলে ডোপটেস্ট করা হবে। এই ভয়ে কেউ পুনরায় মাদকে জড়ান না।

সূত্র বলছে, ওয়েসিসে একসঙ্গে ৪৬ জন পুরুষ ও ১৪ জন নারী মিলিয়ে মোট ৬০ জনকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া বহিঃবিভাগে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা সেবা দেওয়া হয়। তাছাড়া টেলিমেডিসিনের মাধ্যমেও অনেকে সেবা নেন; যেখানে অভিভাবকরা বেশি ফোন করেন। সন্তান বা পরিবারের কোনো সদস্য মাদক সেবন করছে বা লক্ষ্মণ আছে এমন সন্দেহ থেকে অনেকে ফোন করেন। তখন ওয়েসিসের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দেন, যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। প্রতিমাসে দেড়শতাধিকের বেশি মানুষ টেলিসেবা নিয়ে থাকেন। এজন্য ফোন করতে হয় ০১৯৩০-৪০৪০৪০ এই নম্বরে।

যা বলছেন ওয়েসিস-এর চেয়ারম্যান

————————————————-

অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ওয়েসিসে চিকিৎসার মান ও পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি অনেকে বিসিএস পরীক্ষারও জন্য পড়াশোনা করছেন। নারীদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।’

ওয়েসিস প্রতিষ্ঠার প্রায় আড়াই বছর হতে চলছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি কতদূর তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পেরেছে— এমন প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমাদের কাছে যারা সেবা নিতে এসেছেন তারা চিকিৎসা শেষে ফিরে যাওয়ার পরেও তাদেরকে মনিটরিং করা হয়। ফোনে রোগী বা তার স্বজনদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি সুস্থ আছেন কি না। যদি সমস্যা হয় সেটা কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমরা পরমর্শ দিই তিনি যাতে সুস্থ থাকেন। আমাদের কাছে চিকিৎসা নেবার পর একজন মাত্র রোগী পুনরায় নেশায় আসক্তি হয়েছিলেন। পরে তাকে ভর্তি না করে পরামর্শ চিকিৎসায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। এখন নিজেই আমাদের সঙ্গে বিনা পয়সায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে চান।’

প্রতিষ্ঠান চালাতে ভতুর্কি দেওয়া হয় জানিয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার এই সময়ে যতটুকু কাজ আমরা করেছি সবই সাক্সসেসফুলি হয়েছে। এটাকে সমাজের পজেটিভ দিক হিসেবে মনে করি যে পুলিশ আইনের প্রয়োগ না করেও এমন কাজে সফল হচ্ছে।’

ওয়েসিসের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বলেন, বড় পরিসরে করার জন্য মানিকগঞ্জে একটি জায়গা নেওয়া হয়েছে। সেখানে রিসোর্ট টাইপের নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। সেখানে গেলে মনে হবে, মানুষ ঘুরতে আসলে যেমন বিনোদনের জন্য আসে সেখানকার পরিবেশও তেমনই থাকবে। খেলার মাঠ, উমুক্ত জায়গা থাকবে। পাশে কালিগঙ্গা নদীতে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। সেখানকার যে চিকিৎসা পদ্ধতি থাকবে তা সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের। আমরা মনে করি মাদক নিরাময়ের ক্ষেত্রে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।’

আরও খবর

Sponsered content

Powered by