উপ-সম্পাদকীয়

করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি

  প্রতিনিধি ৩০ মার্চ ২০২০ , ৮:০৩:৪৯ প্রিন্ট সংস্করণ

গত বছরের শেষের দিকে চীনের উহান প্রদেশে ধরা পড়ে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নিরব প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাস যা ইতিমধ্যে সারাবিশ্বের মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। বাংলাদেশও এর কবল থেকে রক্ষা পায়নি। দেশে গত ২৪ ঘন্টায় (শনিবার) দুই চিকিৎসকসহ নতুন করে চারজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন পুরুষ, একজন নারী। দেশে মোট রোগির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। সুস্থ হয়েছেন ১১ জন। এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে এক হাজার ২৬ জনের। বিশ্বজুড়ে ভেঙ্গে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবার খুঁটি। অসহায় মানুষ মৃত্যুগ্রাসে বন্দি আবার কোথাও মৃত্যুপুরী। এটি এমনই এক ভাইরাস যে সুযোগ পেলে নিমিষেই রাজা-প্রজা সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসছে। দিনের পর দিন এই করোনা যে পথে হাঁটছে তাতে করে হয়ত ইতিহাসের লোমহর্ষক মহামারীগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে সেই শঙ্কাকেও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

চলমান মরণঘাতী এই এপিডেমিকে এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বের ১৯৫টি দেশে আক্রান্ত ৩ লাখ ৭৯ হাজার এবং সাড়ে ১৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে সময় পাল্টে গেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এখন বিশ্বজুড়ে। নিত্য নতুন চিকিৎসা বিজ্ঞান ও গবেষণায় বিশ্ব এখন মত্ত। তবে পরিতাপের বিষয়, এখনো করোনা ভাইরাসের কোন কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে রাতদিন এই প্রতিষেধক আবিষ্কারে নির্ঘুম কাটাচ্ছেন গবেষকরা। চীনে কয়েক হাজার মৃত্যু হলেও এরই মধ্যে তারা প্রতিরোধে অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় নতুন করে সেখানে আর কেউ আক্রান্ত হয়নি। অন্যদিকে ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।

 
এই মহামারী প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদেরকে আক্রান্ত ব্যক্তি তথা সবার থেকেই সামাজিক দূরত্ব (কমপক্ষে ১ মিটার) বজায় রাখার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। অতি প্রয়োজন ব্যতিত বাড়ির বাহিরে যাওয়া বা গণপরিবহনে যাতায়াত বর্জন করতে হবে। এক্ষেত্রে মাস্ক ও গ্লোভস অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঘি, মধু, ডাল, দানা শস্য জাতীয় খাবার, মাংস, টক দই, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি এবং বেশি করে ভিটামিন সি জাতীয় ফলমূল খেতে হবে। করমর্দন ও কোলাকুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যবহার্য জিনিসপত্র, হাত-মুখ সাবান বা জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গলাব্যথা, কাশি, হাঁচি, শ্বাসকষ্ট, জ্বর বা মাথাব্যথার মত উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রতিটি হাসপাতাল, রোগীর আস্তানা, গণজমায়েত স্থান, বিমানবন্দর ও গণপরিবহনে ব্যাপকভাবে ফিউমিগেশন করতে হবে ও জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। ছোঁয়াচে না হয়ে যদি আক্রান্ত ব্যক্তিই আক্রান্ত থাকতো তাহলে প্রতিরোধ অনেক আগেই করা যেত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী  ওহ অরফ ঃড় ঈরারষ চড়বিৎ- এর আওতায় করোনা সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, সন্দেহভাজনদের হোম কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা পর্যালোচনায় বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করছে।

 শুধুমাত্র কাঁচা বাজার, খাবার, হাসপাতাল ও ঔষধের দোকান ব্যতিত প্রতিরোধের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হিসেবে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, মসজিদে জামায়াতে নামাজ, সরকারি-বেসরকারি কর্মস্থল, জরুরি সেবা ও পণ্য ব্যতিত সকল নৌপথ ও গণপরিবহন এবং প্রায় ধরনের ফ্লাইট সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সংক্রমণ করোনারোধে বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি চলছে। করোনা রোধে মানুষ স্বেচ্ছা গৃহবন্দি। তবে আমাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী, ডাক্তারদের নিরাপত্তার পোশাকসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থার অপ্রতুলতা রয়েছে। তাঁদের প্রতিও মানবিক হতে হবে। চিকিৎসক, নার্সদের নিরাপত্তায় দরকার পিপিই তথা প্রটেক্টিভ গাউন, টুপি, জুতা, চশমা ইত্যাদি। এরই মধ্যে করোনা মোকাবেলায় আরো ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন সরকারের অর্থ বিভাগ। চীন থেকে আনানো হচ্ছে চিকিৎক, কীট ও নানা সরঞ্জাম। পরিতাপের বিষয়, বিদেশ ফেরত বা নতুন করে আক্রান্তদের অনেকেই সরকারি তত্ত্বাবধান বা নিজস্ব হোম কোয়ারেন্টিন মানছেন না। ফলে সেটি আস্তে আস্তে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করছে। তাই এক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিদেশী সাহায্যকারী সংস্থার নাগরিকদের কারণে ক্যাম্পগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মুখে।

 
বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির ভীত এখন নড়বড়ে ও সঙ্কটের মুখে। খেলাধুলা, আমদানি-রফতানি, পর্যটন, উৎপাদনসহ সকল খাতেই দিনদিন ধস নামছে। এরই মধ্যে অলিম্পিক গেমস, কোপা আমেরিকা কাপ, ইউরোপের বিভিন্ন বড় বড় লীগ বা বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশও এরই মধ্যে নানা সংকটে পড়েছে। আমাদের চাঙ্গা অর্থনীতি এখন অনেকটা ভঙ্গুর। করোনার ভয়ে ঘরবন্দি নিম্ন আয়ের মানুষগুলো রয়েছে রীতিমত বিপাকে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের বাজারে চলছে সিন্ডিকেট। তরতর করে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। বিক্ষিপ্তভাবে দেশের নানা জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করলেও নৈরাজ্য থেমে নেই। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি’র) এক প্রতিবেদনে করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে এক বছরে ৯ লাখ কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে এমন শংকার কথা বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মোটাদাগে পাঁচটি খাতে বাংলাদেশে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা খাতে ১১৪ কোটি, কৃষি খাতে ৬৩ কোটি, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও এ সংক্রান্ত সেবা খাতে প্রায় ৫১ কোটি, উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রায় ৪০ কোটি এবং পরিবহন সাড়ে ৩৩ কোটি ডলার অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক বছরে ৩০২ কোটি ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। অস্তিত্ব সংকটাপন্ন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশ কোন পথে হাঁটবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরো জাতি।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by