ঢাকা

বিষাক্ত বর্জ্যের দূষণে গাজীপুরের জলাভূমি জলজপ্রাণী শূণ্য

  প্রতিনিধি ২১ মার্চ ২০২১ , ৯:৪৭:৩৫ প্রিন্ট সংস্করণ

মঞ্জুর হোসেন মিলন, গাজীপুর:

শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বিষাক্ত তরল বর্জ্যে গাজীপুরের প্রকৃতিক জলাশয়ের পানি অনেক আগে থেকেই ব্যবহার অনুপযোগী। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনদিন নীচে নেমে যাওয়া বৃষ্টির পানি কিংবা অন্য উৎস থেকে সংগ্রহের কথা ভাবছে বিষেজ্ঞরা। এ পরিস্থিতিতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন সার্ফেস ওয়াটার ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

 

জেলার বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জলাশয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়। তুরাগ পাড়ের বাসিন্দা মাজেদা বেগম জানান, আমরা আগে তুরাগ নদে গোসল করতাম। কাপড়, হাড়ি পাতিল ধোয়া সহ বিভিন্ন কাজ করতাম।

 

এক কথায় খাওয়া বাদ দিয়ে তুরাগ নদের পানি সব কাজে ব্যবহার করতাম। কয়েক বছর ধরে কলকারখানার দূষিত রঙিন পানি তুরাগ নদে মিশে এই নদের পানি বিষাক্ত করে ফেলেছে। যার ফলে এখন আর তুরাগ নদের পানি কোন কাজেই ব্যবহার করা যায় না। শিল্প কারখানার দূষিত তরল বর্জ্যের উৎকটগন্ধে তুরাগ পাড় দিয়ে চলাফেরা করা যায় না।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মজলিশপুর জেলেপাড়া এলাকার বাসিন্দা শ্রীকান্ত বর্মন জানান, আমার বাপ দাদারা আগে তুরাগ নদসহ বিভিন্ন এলাকায় খাল-বিল থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। আমার পেশাও ছিল মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করা। বিভিন্ন নদ নদী ও খাল বিল থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করতাম। মাছ বিক্রির টাকায় সংসার চলতো। বর্তমানে তুরাগ নদসহ গাজীপুরের বিভিন্ন নদ নদী ও খাল বিলের পানি কল কারখানার তরল দূষিত বর্জ্যে দূষিত হয়ে গেছে। যার ফলে এসব নদ নদী ও খাল বিলে মাছ পাওয়া যায় না।

 

এ কারণে পেশা বদলাতে হয়েছে। এখন আড়ৎ থেকে খামারের মাছ কিনে এনে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাই। আমার মতো শতশত জেলেরা এখন মাছ ধরা বাদ দিয়ে অন্যা পেশা বেছে নিয়েছে।

 

গাজীপুর সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার জান্নাতুন শাহীন বলেন, শিল্পকারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য উন্মোক্ত জলাশয়ে মিশছে। এতে করে গাজীপুরের প্রায় সকল উন্মোক্ত জলাশয়ের পানি দূষিত। এসব জলাশয়ে মাছ কিংবা জলজপ্রাণি নেই। বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়লে ২/৩ মাস অল্প কয়েক ধরণের মাছ পাওয়া যায়, পানি কমলে অতিমাত্রায় দূষিত পানিতে মাছ টিকে থাকতে পারে না।

 

ফলে উন্মুক্ত জলাশয়ে এখন আর মাছের প্রজনন হয়না। ২০ বছর আগে গাজীপুরের বিভিন্ন উন্মোক্ত জলাশয়ে বোয়াল, আইর, বেলে, শিং, মাগুর, বাইম, চিতল, মলা, ফলি, ঢেলা, গুতুম, কাজুলি, রাণী, বাতাসী, চাপিলা, রুই, কাতল, মৃগেল, কালিবাউস ও চিংড়ি- পুটি সহ অনেক প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন এসব মাছ আর গাজীপুরের উন্মোক্ত জলাশয়ে দেখাতো যায়ই না, এমন কি সাপ- শুশুকের দেখাও মেলে না।

 

তিনি আরও জানান, নদীর পানি দূষণ করা, নদী ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করা এবং নদী ড্রেজিং করে নাব্যতা রক্ষার মাধ্যমে পানি দূষণমুক্ত করে মাছের অভয়াশ্রম করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। জলাভূমির প্রতিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে উদ্যোগী হতে হবে।

জনগণের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নে গ্রামীণ এলাকায় প্রয়োজনীয় নিরাপদ পানি সরবরাহে কাজ করছে সরকার। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী বিলকিস আকতার এ প্রতিবেদককে জানান, নিরাপদ পানি নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জেলায় অগভীর নলকূপ, গভীর নলকূপ, সাবমার্সিবল পাম্প ও জলাধার সহ গভীর সাবমার্সিবল পাম্প নির্মাণের কাজ চলছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা করছে সরকার।

 

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আনিসুর রহমান বলেন, নগরীর টঙ্গী ও জয়দেবপুর এলাকায় প্রায় বিশ হাজার গ্রাহককে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা এই সিটির মোট বাসিন্দাদের মধ্যে শতকরা দশ ভাগ। নগরীর সকল বাসিন্দাদের সুপেয় পানি সরবরাহ করতে মেয়র মহোদয়ের প্রচেষ্টায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে নগরীতে সার্ভে কার্যক্রম চলছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে শীতলক্ষ্যা থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি এনে পরিশোধিত করে নগরবাসীদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান বলেন, আর্সেনিক মুক্ত নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ পানি পানের সুযোগ তৈরীসহ সবার জন্য উন্নত উৎসের পানি সরবরাহ সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ভয়াবহ দূষণের শিকার গাজীপুরের চার পাশের নদী ও অভ্যন্তরের সকল প্রকৃতিক জলাশয়ের প্রতিবেশ আজ বিপন্ন। দূষণমুক্ত জলাশয় এবং পানি ব্যবহার উপযোগ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে থেকে ২২ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব পানি দিবস পালন করে আসছে। দিবসটির গুরুত্ব ক্রমশবৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিচ্ছন্ন জল ও জলসম্পদ রক্ষা সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলা এবং নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by