দেশজুড়ে

রাজশাহীতে দেশের প্রথম ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’

  প্রতিনিধি ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৪:১৯:০০ প্রিন্ট সংস্করণ

রাজশাহীতে দেশের প্রথম ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’

রুমে ঢুকতেই চোখে পড়বে বায়োস্কোপ। তার পাশে রয়েছে শত বছরের পুরানো ম্যাজিক লন্ঠন প্রজেক্টর। রেডিও, ভাল্ব রেডিও ছাড়াও দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম। যেগুলো একসময় চলচ্চিত্র তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে। শত বছরের পুরোনো এমন সরঞ্জামগুলো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’।

বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্মস্থান রাজশাহীতে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’। চলচ্চিত্র, নাটক, মঞ্চ নাটক ও সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস তুল ধরার এমন উদ্যোগ নিয়েছেন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা আহসান কবীর লিটন। এমন ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ তৈরির স্বপ্নটা ১০ বছর আগে হলেও এখন সেটি ডানা মেলেছে।

রাজশাহী নগরের শিরোইল মঠপুকুর এলাকায় নিজের প্রচেষ্টায় স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা আহসান কবীর লিটন এমন ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ গড়ে তুলেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যবহার হওয়া এসব যন্ত্রপাতির সমাহার তার কাছে। কখনও কিনেছেন, কখনও সম্পর্কের খাতিরে পেয়েছেন। আবার কখনও বা বিদেশ ভ্রমণ করে কিনে আনতে হয়েছে লিটনকে। যদিও দুর্লভ সরঞ্জামগুলো সংগ্রহ অবস্থায় থাকায় ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ এখনও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। তবে আগামী নভেম্বরের শুরুতে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করার কথা ভাবছেন পরিচালক লিটন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, তিন রুম জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’। রুমগুলোর ছাদ ছাড়া সব জায়গায়ই ব্যবহার হয়েছে আর্কাইভের বিভিন্ন জিনিস রাখার কাজে। কোনটির দেওয়ালে সাটানো, কোনটি মেঝেতে বা ছোট ছোট কাঠের তৈরি স্লিপারের ওপরে রাখা হয়েছে এসব আর্কাইভ। সেখানে স্থান পেয়েছে ১৯১০ সালের দিকে চলচ্চিত্রে ব্যবহার হওয়া ম্যাজিক লন্ঠন ক্যামেরাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। তবে ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ এর জন্য আরও তিনটি রুমের কাজ চলছে। সংগ্রহ বেশি হওয়ায় বিভিন্ন সরঞ্জাম প্রর্দশনী করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। তারপরেও প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম সাজানো হয়েছে। তবে এখনও সেগুলোর নাম পরিচয় যুক্ত বর্ণনা দেওয়া হয়নি। পুরোপুরি কাজ শেষ হলে প্রত্যেকটি সরঞ্জামের আলাদা আলাদাি পরিচয় দেওয়া হবে।

‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’-এ রয়েছে বিভিন্ন জেনারেশনের ৪৮টি রেডিও। এরমধ্যে কয়েকটি ক্যাসেট রয়েছে। এখানে সবচেয়ে পুরানো ৫০ দশকের ভাল্ব রেডিও রয়েছে। রয়েছে টিউব রেডিও। এই রেডিওগুলো মনে করিয়ে দেবে গানের অনুষ্ঠান ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’র কথা। ক্রিকেট খেলায় ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাতের কথা। এছাড়া ৬০টির মত টেলিফোন রয়েছে। যদিও এখন মাত্র আটটি ডিসপ্লেতে রাখা হয়েছে। এই সব টেলিফোন আশির দশকের। এই টেলিফোনগুলো মনে করিয়ে দেবে বাংলা হিন্দি সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যগুলো। তবে সিনেমার সেই দৃশ্যের কথাগুলো তেমন মনে না থাকলেও নিশ্চয় মনে আছে বাংলার সেরা ক্লাসিক গানগুলির মধ্যে অঞ্জন দত্তের সেরা গান (বেলা বোস)। এই গানটিতে প্রিয় মানুষকে টেলিফোনে নিজের চাকরির খবর দিয়েছেন গানে গানে।

একই সঙ্গে থরে-থরে সাজানো রয়েছে টাইপ রাইটার। টাইপ রাইটারগুলো ওলেমপিয়া কোম্পানির। যেগুলো দিয়ে বাংলাদেশে টাইপ রাইটারের যুগ শুরু হয়। এখানও ওলেমপিয়া কোম্পানির না থাকলেও বিভিন্ন কোম্পানির টাইপ রাইটার জেলা ও বিভাগীয় শহরের কোটগুলোতে দেখা যায়। যেখানে রাইটার দ্রুত গতিতে বিভিন্ন লেখা লেখেন। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন দেশের ধাতব মুদ্রা ও কাগজের নোট। ধাতব মুদ্রা ও কাগজের নোট সংগ্রহ অবস্থায় রয়েছে।

‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ এর দ্বিতীয় ঘরে রয়েছে ছয় ধরনের বাঁশি। এরমধ্যে কিছু বাঁশের বাঁশি রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজানো কর্নেট বাঁশি রয়েছে এখানে। রুমটির পশ্চিম দেওয়ালে কর্নেটের বাঁশিগুলো দেওয়ালের সঙ্গে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই বাঁশিগুলোর সাধারণত সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যান্ডপার্টির লোকজনকে বাজাতে দেখা যায়। এছাড়া সনাতন ধর্মালম্বীদের বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজাতে দেখা যায় এইসব কর্নেট বাঁশি। এছাড়া বিলুপ্তের পথে শারদ শঙ্খ, নাগরার ঢোলক, ঢোল, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, ডুগডুগি, বিন সংগ্রহে রয়েছে। প্রচলিত আছে- বেদেরা সাপ ধরতে ব্যবহার করেন এই বিনের। নাগ-নাগিনীর বিভিন্ন সিনেমায় বিন বাজিয়ে সাপ ধরতে দেখা যায় বেদেদের। এই বিন চোখে পড়লে মনে হবে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমার কথা। আশির দশকের এই সিনেমা এখনও মানুষের অন্তরে গেঁথে আছে।

‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ এ রয়েছে পুরোনো বিভিন্ন কোম্পানির ১৭টি ক্যামেরা। এসব ক্যামেরাগুলো বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের। সেই সময় সিনেমা বা বিভিন্ন স্টুডিওতে এই ক্যামেরাগুলো ব্যবহার হতো। রয়েছে ১টি ভিডিও ক্যামেরাও। যা সিমেনার শুটিংয়ের কাজে ব্যবহার হয়েছিল। এছাড়া রয়েছে, বায়োস্কোপ। গ্রামের বিভিন্ন মেলায় এই বায়োস্কোপের দেখা পাওয়া যেত। এই বায়োস্কোপগুলো শিশুদের মজার খোরাক যোগাতো।

শুধু তাই নয়, ১৫ বছর আগে সিনেমা দেখায় জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল ডিজিটাল প্রজেক্টর, সিডি, ডিভিডি। এই সিডি বা ডিভিডিতে গ্রামের চায়ের দোকানগুলো বা হোটেলগুলোতে চলতো বাংলা সিনেমা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ বিভিন্ন সিনেমা দেখত এই সিডি বা ডিভিডিতে। বায়োস্কোপের চেয়ে পুরানো ম্যাজিক লন্ঠন প্রজেক্টর। ১৯০০ সালের দিকে ম্যাজিক লন্ঠন ক্যামেরার ব্যবহার ছিল। সেই সময়ে উন্নত দেশগুলোতে ম্যাজিক লন্ঠন প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি দেখানো হতো। সেই সময়ে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল এটি। এছাড়া রয়েছে সাদা-কালো তিনটি টেলিভিশন। রয়েছে বিভির স্ট্যান্ডও। কালের বির্বতনে হারিয়ে গেছে এসব জিনিস।

দর্শনার্থী ফাতেমা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমন উদ্যোগ ব্যক্তিগত প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তিনি অনেক পুরানো বিভিন্ন চলচ্চিত্রের সরঞ্জাম এক ছাদের নিচে নিয়ে এসেছেন। এখানে ঢুকলে মনে হয়ে যাবে ছেলে বেলায় ফেলে আসা বিভিন্ন স্মৃতি। সাদাকালো টেলিভিশন দেখে মনে পড়ে যায় ক্লিয়ার ছবি দেখতে অ্যান্টিনিয়ার ঘুরানোর কথা। বায়োস্কোপ দেখে মনে হয় গ্রামের মেলার কথা। আর বিন দেখে নাগ-নাগিনীর বিভিন্ন সিনেমার মধ্যে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র কথা মনে হলো। এখানে এসে আশির দশকের এই সিনেমার স্মৃতির কথা মনে গেল।

‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ এর কিউরেটর শামীউল আলীম শাওন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই আর্কাইভে বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ব্যবহার হওয়া ক্যামেরা, ভিডিও, ম্যাজিক লন্ঠন রয়েছে। এছাড়া বায়োস্কোপ, প্রজেক্টর, টেলিফোন, রেডিও তাদের সংগ্রহে রয়েছে। আমাদের এখানে পুরানো কোনো জিনিস কেউ দিলে আমরা নিচ্ছি।

‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ এর পরিচালক আহসান কবীর লিটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দুর্লভ ক্যামেরা, ম্যাজিক লন্ঠন, সাদা কালো টেলিভিশন, শারদ শঙ্খ, নাগরার ঢোলক, ঢোল, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, ডুগি ডুগডুগি, বিন রয়েছে। আমরা তিনটি রুম নিয়ে শুরু করেছি। তবে এখনও দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেইনি। আশা করছি আগামী নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, এখানে ১৫০০টি বিভিন্ন দুর্লভ বই রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ১৯৭০ সালের কিছু বই রয়েছে। এছাড়া হুময়ান আহমেদের বেশি কিছু বই রয়েছে। নাটক, কবিতা, সিনেমার বই রয়েছে। আমরা টার্গেট ১০ হাজার বইয়ের। আমরা কাজ করছি। আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের বিভিন্ন উপহার দিচ্ছেন। সেগুলো আমরা এখানে রাখছি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি সাজ্জাদ বকুল বলেন, সংগীতাঙ্গনের নানা বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। এগুলো দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সমৃদ্ধ একটা ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ হতে যাচ্ছে। অনেক পুরানো জিনিস এখানে স্থান পেয়েছে। দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্রে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন জিনিস এখানে রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে বায়স্কোপ, ম্যাজিক লন্ঠন ক্যামেরা, সাদা কালো টেলিভিশন। এগুলো দেখে মনে হয়েছে কীভাবে পরিবর্তন হলো আজকের চলচ্চিত্র।

Powered by