দেশজুড়ে

সিংড়ার যে গ্রামে ২শ বছরেও হয়নি কোনো মামলা

  প্রতিনিধি ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৫:১৬:৩২ প্রিন্ট সংস্করণ

সিংড়ার যে গ্রামে ২শ বছরেও হয়নি কোনো মামলা

নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামটির পাশেই চলনবিল। গত মঙ্গলবার নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে এই প্রতিবেদক গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে গ্রামের প্রবেশমুখে বিশাল একটি গেট। যেখানে লেখা রয়েছে আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া। ২০১০ সালে তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এ গেটটি স্থাপন করে দেন।

গ্রামবাসী মনে করেন, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ও শতভাগ শিক্ষিত হওয়ার কারণে মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও মনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এ কারণে গ্রামের মানুষজন কলহ ও সংঘাত থেকে দূরে থাকেন। এছাড়া গ্রামটি পরিচালনার জন্য তাদের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। যা সবাই মেনে চলেন। গ্রামে কোনো সমস্যা-সংকট দেখা দিলে গ্রামবাসী মিলে সংবিধানের আলোকে তা সমাধান করেন।

এজন্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত তাদের একটি কমিটিও রয়েছে। এছাড়া স্কুল, মাদ্রাসা, বাজার, মসজিদ ও গোরস্থান ভিত্তিক তাদের আলাদা আলাদা পরিচালনা কমিটিও রয়েছে। এ কমিটিও ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। গ্রামবাসী গ্রামের মধ্যে কোনো বিভাজন তৈরি করেন না। দরিদ্রদের সহায়তায় সবাই একসাথে এগিয়ে আসেন। গ্রামের জনসংখ্যা ৬ হাজার হলেও প্রায় ৪ হাজার মানুষ গ্রামের বাইরে চাকরি করেন।

তারাও অর্থনৈতিকভাবে গ্রামবাসীকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। ছেলেমেয়েদের জন্য এসএসসি পাশ করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাশ না করালে কেউ তার মেয়েও বিয়ে দিতে পারেন না। দরিদ্রদের শিক্ষার জন্য দরিদ্র তহবিল কমিটিও আছে যে কমিটি থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সহায়তা করা হয়ে থাকে। গ্রামের ৬১ বছর বয়সী বাসিন্দা রেজাউল হোসেন বলেন, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য এসএসসি পাশ করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাশের আগে কেউ তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। যদি কেউ কোনো কারণে তার মেয়েকে ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে দিতে চাইলে, কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে তা জেনে সমাধান করা হয়। কিন্তু এসএসসি পাশ না করে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিয়ের সময় যৌতুক নেওয়া ও দেওয়াও এখানে সম্পূর্ণ নিষেধ।

গ্রামটি শতভাগ মাদকমুক্ত ও সবার জন্য স্যানিটেশনের ব্যবস্থা আছে।বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রাম থেকে হুলহুলিয়া গ্রামটিকে যে কারণে পৃথক করেছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামের সামাজিক প্রতিষ্ঠান। একে গ্রামের উচ্চ আদালতও বলা হয়। এই পরিষদের মাধ্যমেই গ্রামের সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এবং গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো কলহ দেখা দিলে তা মীমাংসা করা হয়।সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ পরিচালনার একটি কমিটিও রয়েছে। কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ সদস্য রয়েছেন আরও ২১ জন। তারা সবাই গ্রামের পুরুষ ভোটারদের দ্বারা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। দুই বছর পর পর ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, যারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন তারাই সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এছাড়া পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও রয়েছে তাদের। এছাড়া গ্রামের বিচার বিভাগীয় আটটি পাড়াতেও আলাদা আলাদা কমিটি রয়েছে। যাকে বলা হয় নিম্ন আদালত। এই কমিটি পাড়ার আকার-আকৃতি অনুসারে ৫ থেকে ৮ সদস্যের হয়ে থাকে।গ্রাস ঘুরে ভোরের দর্পণের সিংড়া উপজেলা প্রতিনিধি রবিন খান জানায়, ১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। গ্রামের অনেক চাষি ধান-বীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা।

বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধান-বীজ আছে, তারা বিনাশর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের উন্নয়নে ১৯৪০ সালে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠিত হয়। হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আল তৌফিক পরশ ভোরের দর্পণ’কে জানান, গ্রামের কোনো সদস্যের কোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে ওই পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। তারা না পারলে তার বাদবাকিরা চেষ্টা করেন। তারা না পারলে তখন পাড়ার যে কমিটি আছে, সেই কমিটি বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। তারাও ব্যর্থ হলে তখন সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে বিষয়টি তোলা হয়। সেখানে যে রায় দেওয়া হয় সেটি সবাই মেনে নেয়।

এ কারণেই কাউকে কোর্ট-কাছারিতে যেতে হয় না। পুলিশ ডাকারও প্রয়োজন হয় না। এটা আমাদের গত ২০০ বছরের ইতিহাস।১৯৪০ সালে মছির উদ্দিন মৃধা নামের গ্রামের এক ব্যক্তি এই সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ গঠন করেন ও গ্রাম পরিচালনার সংবিধান তৈরি করে লিখিত রূপ দেন। এই গ্রামে হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব নামে আরো একটি সংগঠন রয়েছে, এই গ্রামে ১৯৪২ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। মরহুম মফিজ উদ্দিন প্রামানিক ক্লাবটি গঠন করেন। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী। তাদের অনুদানে গ্রামের অভাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।গ্রামের মানুষজন শতভাগ শিক্ষিত। সব ছেলেমেয়ের জন্যই এসএসসি পাশ করা বাধ্যতামূলক। কোন পরিবারের ছেলে-মেয়ে দরিদ্রতার কারণে তার সন্তানকে পড়ালেখা করাতে না পারলে তখন দরিদ্র তহবিল কমিটি থেকে সেই ছেলেমেয়ের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া হয়। চাকুরিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে সহায়তা করা হয়। চাকরি পাওয়ার পর তা পরিশোধ করতে হয়।

গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদ রয়েছে। গ্রামটি থেকে ২শোর অধিক বিএসসি প্রকৌশলী, শতাধিক এমবিবিএস ডাক্তার, ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১১ জন বিচারকসহ নানা পেশার মানুষ ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। হুলহুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম জানান, আমাদের গ্রামে মসজিদ একটিই, গোরস্তানও একটি। দুটি মসজিদ কখনোই করতে দেওয়া হবে না। কারণ দুটি মসজিদ হলে গ্রাম ভাগ হয়ে যাবে। আমরা কখনোই গ্রামের বিভক্তি চাই না।এই গ্রামে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মরহুম মোহাম্মদ হানিফ উদ্দিন মিয়া এই গ্রামের বাসিন্দা।

এছাড়া তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল হাব স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে আইন বিভাগের সাবেক সচিব মরহুম একে কাদের তালুকদার, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মির্জা মনজুরুল কাদের জুয়েল, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এমএম রহমতুল্লাহ ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ইঞ্জি. জমসেদ আলী রয়েছেন।

এছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ইউনিটের চেয়ারম্যান ডা. মাহবুবুর রহমান, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডীন ড. মন্টু তালুকদার ও কেন্দ্রীয় গণ-গ্রন্থাগার পরিচালক ড. জিল্লুর রহমান এই গ্রামের বাসিন্দা।হুলহুলিয়া ডিজিটাল হাব ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৬ সালে হুলহুলিয়াতে ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জব্বা ও বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এটি উদ্বোধন করেন। এই ডিজিটাল হাব সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে ১১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর, একটি লাইভ টেলিভিশন রয়েছে। এছাড়া একটি ডিজিটাল ইসিজি রুমও রয়েছে। হুলহুলিয়া গ্রামের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে।আল তৌফিক পরশ ভোরের দর্পণের প্রতিনিধি রবিন খানকে বলেন, ডিজিটাল হাব থেকে সরাসরি গ্রামের মানুষদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এছাড়া যেকোনো ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। আর ওয়েবসাইট থেকে আমাদের গ্রাম বিষয়ে তথ্য জানার সুযোগ আছে।চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহেদুল ইসলাম ভোলা জানান, পরিষদ থাকায় হুলহুলিয়া গ্রামে কোনো বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে। যেটুকু হয় সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে তা সমাধান করা হয়। শতভাগ শিক্ষিত হওয়ায় গ্রামটি সিংড়া উপজেলার মধ্যে আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃত।

“সিংড়া থানা অফিসার ইনচার্জ আবুল কালাম বলেন, দুই মাস হচ্ছে আমি এই থানায় চাকরি করছি। এই দুই মাসে তাদের কোনো মামলা মোকদ্দমা করতে দেখা যায়নি। হুলহুলিয়া গ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক।

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা খাতুন বলেন, আমি শুনেছি, হুলহুলিয়া গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর কোনো ধরনের মামলা মোকদ্দমা নেই। গ্রামেই বিচার সালিশ হয়। তবে এখন সেই বিচারব্যবস্থা ঠিক সেভাবে মানা হয় না বলে লোকমুখে শুনেছি।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by