ময়মনসিংহ

৩৫ বছর পর হাসিনা খুঁজে পেল তার আপন ঠিকানা

  প্রতিনিধি ২০ ডিসেম্বর ২০২২ , ৯:১৫:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ

নান্দাইল ( ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি:

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর ইউনিয়নের গঙ্গাপুর গ্রামের খোরশেদ আলমের মেয়ে হাসিনা আক্তার। তখন বয়স পাঁচ কি ছয়। মায়ের বকুনি খেয়ে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান,আর বাড়ি ফিরে আসেননি। তখন ছিল রমজান মাস।

হাসিনা আক্তার চলে যান স্থানীয় খায়ের হাট বাজারের পাশের লঞ্চঘাটে। লঞ্চে উঠার পর এক পর্যায়ে সেখানকার লঞ্চ তাকে ভিড়ায় রাজধানীর সদরঘাটে। এরপর কীভাবে ফিরবেন বাড়ি, এই ভেবে একটি দোকানের সামনে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকেন হাসিনা।

ছোট শিশু হাসিনার এই কান্না দেখে কাছে ছুটে আসেন হাসিম উদ্দিন। কেরানীগঞ্জের বরিশুর বাজার কালন্দী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। হাসিনাকে কাছে টেনে নেন তিনি। নাম ঠিকানা বলতে না পারা শিশু হাসিনাকে বাসায় নিয়ে যান। স্ত্রী সখিনা আর তিনি নিজের সন্তানের মতোই তাকে লালন- পালন করতে থাকেন। আর নিজের পরিবার হারিয়ে আরেক পরিবারে বড় হতে থাকেন হাসিনা।

১৪ বছর বয়সে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের অরণ্যপাশা গ্রামের ফজলুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় হাসিনার। বিয়ের পরপরই মারা যায় তাকে লালনপালন করা বাবা হাসিম উদ্দিন ও মা সখিনা খাতুন। এরই মধ্যে হাসিনা হন চার মেয়ে আর দুই ছেলের মা।

প্রায় ৩৫টি বছর এভাবেই কেটে গেছে হারিয়ে যাওয়া হাসিনা আক্তারের (৪০)। তার স্বপ্ন ছিল কোনো এক দিন ফিরে পাবেন নিজের পরিবারকে। ফিরে পাবেন নিজের বাবা মাকে। সেই স্বপ্নের পথে পা বাড়িয়ে ৯ মাস আগে হাসিনা যান ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানে। জনপ্রিয় আরজে গোলাম কিবরিয়া উপস্থাপনায় সেই অনুষ্ঠানে খুলে বলেন হারিয়ে যাওয়ার ‘করুণ’ গল্প।

অপেক্ষার প্রহর শেষে গত ৪ ডিসেম্বর ‘আপন ঠিকানা’র আপডেট অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ৩৫ বছর পর হাসিনা খুঁজে পান তার বাবা খোরশেদ আলম ও মা মরিয়ম আক্তারকে। বাবা খোরশেদ আলম ফিরে পান তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে।মেয়ের খোঁজ পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন খোরশেদ আলম ও তার স্ত্রী মরিয়ম আক্তার।

পরিচয় নিশ্চিত করতে স্টুডিওতে হাসিনার কাছে প্রথমে আনা হয় মা মরিয়মকে। বিভিন্ন ঘটনা মনে করে তা মেলাতে থাকেন তারা। এক পর্যায়ে হাসিনার থুতনিতে থাকা ছোটবেলার একটি কাটা দাগের ঘটনার মাধ্যমেই হাসিনা নিশ্চিত হন এটিই তার পরিবার। পরে বাবা খুরশিদ আলমকে স্টুডিওতে আনা হলে শুরু হয় তিনজনের কথোপকথন। আলাপচারিতায় তিনজনেই ফিরে যান ৩৫ বছর আগে। বাবা-মা ও সন্তানের মিলনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

সরেজমিন হাসিনার স্বামীর বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার অরণ্যপাশা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গোটা পরিবারে বইছে আনন্দের বন্যা। মেয়েকে দেখতে গত ১২ ডিসেম্বর বাবা খোরশেদ আলম ভোলা থেকে পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে এসেছেন মেয়ের বাড়িতে। মেয়েকে কাছে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা খোরশেদ আলম।

হাসিনা আক্তার বলেন,আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আপন ঠিকানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি আমার পরিবারকে ফিরে পেয়েছি। আজ আমার আনন্দের শেষ নেই।ছোটবেলায় নিজের মা-বাবাকে হারিয়েছি। তাদের আদরসহ অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, যারা আমাকে বড় করেছেন, আমার বিয়ের পর তারাও মারা যান। আমার সন্তানরা সব সময়ই তাদের নানাবাড়ি যেতে চাইতো। আমি তাদের জন্য হলেও আমার পরিবার ফিরে পেতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমার স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে।

হাসিনার বাবা খোরশেদ আলম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেন, ৩৫ বছর পর শেষ বয়সে এসে মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। মেয়েকে হারানোর পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। আল্লাহর কাছে প্রতিদিনই চাইতাম যেন মেয়েকে ফিরে পাই। আমরা পরিবারের ৮ জন সদস্য নিয়ে মেয়েকে দেখতে নান্দাইল এসেছি। মেয়ের পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভোলায় আমাদের বাড়িতে যাব।

হাসিনার স্বামী ফজলুর রহমান বলেন,দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর পর আমি শ্বশুর-শাশুড়ি পেয়েছি, এতেই আমি অনেক খুশী।আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব। আল্লাহর ইচ্ছাতেই আজ এমন খুশির দিন পেলাম আমরা।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by