উপ-সম্পাদকীয়

করোনাভাইরাসে অর্থনীতির মন্দাভাব ও করণীয়

  প্রতিনিধি ২ এপ্রিল ২০২০ , ২:১২:৪৩ প্রিন্ট সংস্করণ

ওসমান গনি: করোনাভাইরাসের বড় ধাক্কা লাগছে বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। ভাইরাসটির কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের আমদানি ও রপ্তানি প্রায় বন্ধের পথে। কর্মহীন হয়ে পড়ছে কোটি কোটি মানুষ। এক এক করে বন্ধ হতে চলছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। বিশ্ব অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে মন্দা ভাব। কাঁচামালের অভাবে আমাদের বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশের শিল্প-কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অপরদিকে সীমিত হয়ে আসছে পণ্য আমদানি ও রফতানি। এ ধাক্কার কারণে বহির্বিশ্বে আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিকের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম অসন্তোষ। তবে বৈশ্বিক এই মহামারি ছড়ানোর অনেক আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সতর্ক করে বলেছিল, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা ভঙ্গুর এবং নানামুখী ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের আরও আশঙ্কা, যদি উল্লিখিত এসব ঝুঁকির মধ্যে কোনো একটিও বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও হ্রাস পাবে।

অর্থনীতিবিদরাও আগে সতর্ক করেছিলেন যে, করোনাভাইরাস এমন একটি ধাক্কা দিতে পারে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জরুরি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও প্রতিদিনই এটা বিস্তার লাভ করছে। চীনের মধ্যাঞ্চল থেকে গোটা দেশ এবং বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। গত ডিসেম্বরে চীনের এই মধ্যাঞ্চল থেকেই এর বিস্তার শুরু।জানুয়ারি থেকে চীনে উৎপাদন কারখানা বন্ধ এবং শহরগুলো অবরুদ্ধ। সৌদি আরব বিদেশিদের মক্কা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাতিল করেছে ওমরাহ ভিসা। এদিকে জেনেভায় বিশ্বের গাড়ি শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল মোটর শো’ বাতিল হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বাতিল হয়েছে ঘড়ি মেলা ‘ব্যাসেলওয়ার্ল্ড’।বিজিএমইএর হিসাব মতে, প্রায় পৌনে ১৩ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ স্থগিত করা হয়েছে। অনিশ্চয়তার কারণে কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের ওপর চাপ বেড়েছে। ফলে পণ্যের এ মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে সহায়তা করবে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দায় রাজস্ব আহরণেও ঘাটতি পড়বে। ধাক্কা লেগেছে রেমিটেন্স খাতেও। সব মিলে পুরো সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে বলে অভিমত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

 
 জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে করোনার প্রভাব পড়বে। কারণ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। চীন থেকে পণ্য আসা কমেছে ২৬ শতাংশ। কাঁচামাল দেরিতে আসায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া পণ্য রফতানিতেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ বাস্তবতার সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। করোনার প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ আসছে। কত বেশি চাপ সৃষ্টি হবে এটি নির্ভর করবে করোনা দীর্ঘায়িত হওয়ার ওপর। কারণ ইতোমধ্যে আমদানি ও রফতানি কমেছে। পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানি হ্রাস ও সংকটের কারণে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এতে প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রাজস্ব আয়ে ঘাটতি বাড়বে। ৮ মার্চ আমাদের বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগি শনাক্ত হয়। এরপর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। করোনার প্রভাবে এ পর্যন্ত (২২ মার্চ) এক হাজার ৮৯টি কারখানার প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের (দেশি মুদ্রা ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার) ক্রয় আদেশ স্থগিত হয়েছে। বর্তমানে এ খাতটি গভীর সংকট পার করছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে রফতানি আয় কমেছে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

এদিকে আমদানিও কমেছে। জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য জাহাজ আমদানি আগামী ৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া বন্দরে পণ্য আসার পরিমাণ ক্রমেই কমছে। স্বাভাবিক সময়ে ৪৯ হাজার টিইউএস ধারণ ক্ষমতার চট্টগ্রাম বন্দরে ৪৫ হাজার টিইউএসের বেশি কনটেইনার থাকত। আর সম্প্রতি সেটি ৩৪ হাজার টিইউএসে নেমে এসেছে। করোনা প্রভাবে জাহাজের সংখ্যা কমে গেছে এবং ক্রমান্বয়ে আরও কমছে। এর ফলে রাজস্ব আহরণ কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরে ৮৭ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। সিপিডি মনে করছে, রাজস্ব আদায়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, করোনা ছাড়াই ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা হবে। এরপর করোনার কারণে এটি আরও বাড়বে এটি সহজেই বলা যায়।

করোনা পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের বাজারে চাপ বেড়েছে। সরকারি হিসাবেই এক মাসে সব ধরনের চালের মূল্য কেজিতে বেড়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। একসঙ্গে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাল-ডালসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি থেমে নেই। সব মিলিয়ে করোনায় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যতদূর জানা যায়, করোনা রোগি শনাক্তের পর দাম বৃদ্ধির প্রথম আঘাত আসে মাস্কের ওপর। ব্যবসায়ীরা বসে থাকে সুযোগের আশায়। কোন ক্ষেত্র বিশেষ সুযোগ পেলেই তারা সেটা কাজে লাগায়। তাছাড়া রয়েছে আমাদের দেশে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী। করোনাভাইরাসের খবরটা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে মানুষের ব্যবহারের একটা সামান্য মাস্কের দাম বেড়ে গেছে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। শুধু মাস্ক নয় মানুষের প্রয়োজনীয় সব নিত্যপণ্য কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। সরকার দ্রব্যমূল্য কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।

 
কিন্তু আমাদের দেশের লোকজন করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্কিত হয়ে অধিক পরিমান পণ্য এক সাথে কেনার কারণে ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়াছে।কিন্তু আমাদের দেশের সরকার বলছে আমাদের যথেষ্ট পরিমান পণ্য মজুদ রয়েছে। আমাদের কোন সমস্যা হবে না। কে শোনে কার কথা। চাহিদার কয়েকগুণ মজুদ আছে নিত্যপণ্যের। অন্য বছরের তুলনায় এবার মজুদের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।এদিকে আমাদের দেশে রেমিটেন্সেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যা আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। যাদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছি। করোনাভাইরাসের কারণে শুধু যে, আমাদের রেমিটেন্সের ওপর প্রভাব পড়ছে তা নয়। আমাদের দেশের যে সমস্ত রেমিটেন্স যোদ্ধা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান  করছে সে অর্থনীতির ভিত্তি যদি মজবুত ও শক্তিশালী না হয়, তাহলে হয়তো আমাদের দেশের রেমিটেন্সের যোদ্ধারা দেশে চলে আসা লাগতে পারে।

 তারা যদি দেশে চলে আসে তাহলে আমাদের সার্বিক পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে? তখন হয়তো আমরা অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়তে পারি।শুধু তাই নয়, বেড়ে যাবে দেশে বেকার লোকের সংখ্যা। সংসার, সমাজ ও পারিবারিক জীবনে চলে আসবে কলহ আর অশান্তি। ক্ষয়ের পথে চলতে থাকব আমরা ও আমাদের অর্থনীতি। গত এক মাসে রেমিটেন্স কমেছে ১৯ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্টরা জানান, চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া ভাইরাসটি ইতোমধ্যেই অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বড় অঙ্কের রেমিটেন্স আসে- এমন দেশও রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিতে ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। যে কারণে এ খাতে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে। প্রবাসীরা কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। চাকরিচ্যুত কিংবা কর্মহীন হয়ে পড়বেন কিনা, সে কারণে অনেকে টাকা পাঠাতে চাইবেন না। আবার দেশে পাঠালেও সে টাকার অপব্যবহার হবে কিনা। এ ধরনের নানা সংশয়ে আছেন প্রবাসীরা। এদিকে আমাদের দেশের একমাত্র কৃষিপণ্যের যথেষ্ট উৎপাদন ও মজুদ আছে। এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ টন খাদ্য মজুদ রয়েছে। গত বছরের চেয়ে যা দেড় লাখ টন বেশি।

 
করোনাভাইরাসের কারণে যদি অর্থনীতির মন্দাভাব দেখা দেয় তাহলে আমরা কি আমাদের একমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে চলা যাবে? মনে হয় না। তারপরও আমাদের দেশের মানুষের প্রধান পেশা কৃষির উপর জোরেশোরে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি উপকরণের দাম সকল কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে।কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য যাতে কৃষকরা পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হব। সরকারিভাবে কৃষকদের মধ্যে যে উপকরণ বিতরণ করা হয় তা যেন অসচ্ছল কৃষকরা পায় তার প্রতি সুদৃষ্টি রাখতে হবে।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by