চট্টগ্রাম

দেলোয়ারসহ ২ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা : গৃহবধূকে মুখে কুলুপ আঁটতে বলেছিলেন ইউপি মেম্বার

  প্রতিনিধি ৭ অক্টোবর ২০২০ , ১১:৫৬:৫৪ প্রিন্ট সংস্করণ

মোয়াজ্জেম সোহাগ ও নুর হোসেন বাদল

ভোরের দর্পণ অনলাইন:

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নে সম্প্রতি স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করার জন্য চালানো বর্বরোচিত নির্যাতন এবং তা মোবাইল ফোনে ধারণ করে সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কাণ্ডে গ্রেপ্তার দেলোয়ার হোসেন ৩৬ বছর বয়সী ওই নারীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এর আগেও একাধিকবার ধর্ষণ করেছিল। প্রায় সময়ই শারীরিক সর্ম্পকে সম্মত না হলে ওই নারীকে সে হুমকি দিত, বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে গণধর্ষণ করা হবে বলে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে এ তথ্য জানিয়েছেন নির্যাতিত ওই নারী।

ওই গৃহবধূ জানিয়েছেন, বিবস্ত্র করে নির্যাতন করার পর তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগের কাছে বিচার চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মেম্বার সোহাগ কোনো বিচার করেননি। উল্টো ভূক্তভোগী নারীকে বলেছিলেন, মুখে কুলুপ এঁটে রাখতে। মেম্বারের এ আচরণে ওই নারী বিচার পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। গতকাল পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির কাছে এ তথ্য তুলে ধরেছেন বিচারবঞ্চিত ওই নারী।

নির্যাতিত ও অসহায় ওই নারী মেম্বারের কথায় মুখে কুলুপ এঁটে রাখলেও সম্প্রতি তার ওপর চালানো নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে চলছে প্রশাসনের তৎপরতা। তার করা দুটি মামলায় গতকাল মেম্বার সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগকে একলাশপুর থেকে এবং মামলার ৫ নম্বর আসামি সাজুকে ঢাকার শাহবাগ থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এ দুজনসহ মামলায় মোট গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬ জনকে। এছাড়া নির্যাতনকা-ের অন্যতম হোতা দেলোয়ারকে অস্ত্র মামলায় গতকাল দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এদিন সন্ধ্যায় নির্যাতিত গৃহবধূ তাকে এক বছর আগে ধর্ষণ করার কা-ে দেলোয়ার ও তার সহযোগী আবু কালামের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এর আগে একই থানায় ৯ জনের বিরুদ্ধে পর্ণোগ্রাফি আইনে মামলা করেন ওই নারী। যেখানে তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ এনেছেন।

গৃহবধূ নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ-তদন্ত) আল আহমুদ ফয়জুল কবির বেগমগঞ্জে গিয়ে ওই গৃহবধূর সঙ্গে কথা বলেন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি।

আল আহমুদ ফয়জুল কবির সাংবাদিকদের জানান, গতকাল সকালে বেগমগঞ্জ থানায় তিনিসহ তাদের তদন্ত কমিটির সদস্যরা ওই গৃহবধূর সঙ্গে কথা বলেন। গৃহবধূ তাদের কাছে অভিযোগ করেন, এক বছর আগে দেলোয়ার তার ঘরে ঢুকে প্রথমে তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়। তিনি চিৎকার করতে চাইলে দেলোয়ার তাকে বাহিনীর লোক দিয়ে ধর্ষনের পর খুন করার হুমকি দেয়। তখন প্রাণ বাঁচাতে তিনি মুখ বুজে শারীরিক সম্পর্কে বাধা দেননি। এর কিছুদিন পর দেলোয়ার ও তার সহযোগী কালাম ওই নারীকে তার বাড়ী থেকে বের করে একটি নৌকা যোগে পাশের একটি বিলে নিয়ে যায়। সেখানে দেলোয়ার ও কালাম তাকে গণধর্ষণের চেষ্টা করলে হাতে পায়ে ধরে কালামের হাত থেকে রক্ষা পেলেও দেলোয়ার তাকে নৌকার মধ্যে ধর্ষণ করে।

আল আহমুদ ফয়জুল কবির আরও জানান, এ ঘটনায় নির্যাতিতা বাদী হয়ে আদালতে ধর্ষণ মামলা করবেন। মামলাটি পরিচালনা করবেন এড. জাফর উদ্দিন বাবুল। আদালতে ২২ ধারায় পুনরায় ভিকটিমের জবানবন্দী রেকর্ড করা হবে। তদন্ত শেষে চুড়ান্ত রিপোর্ট মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করা হবে বলে তিনি জানান।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের উপ-পরিচালক গাজী সালাউদ্দিন, নোয়াখালী জেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কামরুন নাহার প্রমুখ।

অন্যদিকে গতকাল বেগমগঞ্জ থানার ওসি মো.হারুন উর রশীদ জানান, সাজু (২১) একলাশপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের নোয়াব আলী বেপারী বাড়ির লোকমানের ছেলে। অন্যদিকে ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগ (৪৮) একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও একই এলাকার মৃত হাজী গোলাম মোস্তফা’রছেলে।

ওসি জানান, আদালতে ভিকটিমের জবানবন্দি অনুসারে ইউপি সদস্যকে ২২ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়।

গত সোমবার দিনগত রাতে রাতে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে নির্যাতিতা গৃহবধূ (৩৫) বাদী হয়ে ৯ জনকে জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র‌্যাব তিন দফায় অভিযান চালিয়ে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে।

নোয়াখালী জজ আদালতের পিপি এড. গোলজার আহমেদ জুয়েল বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত প্রধান আসামি বাদলের ১০দিনের রিমান্ডের আবেদন করে গতকাল বিকারে ৩নং আমলি আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মাসফিকুল হকের আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে শুনানি শেষে প্রধান আসামি বাদলকে দু’টি মামলায় পৃথকভাবে ৭দিন ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগকে ২দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

 

অস্ত্র মামলায় দেলোয়ার ২ দিন রিমান্ডে

গৃহবধূ নির্যাতনের ঘটনার অন্যতম সহযোগী দেলোয়ারকে সোমবার অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। এঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় গতকাল মঙ্গলবার দেলোয়ারকে ৩দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। পরে আদালত তার ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে তাকে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ফাহমিদা খতুনের আদালতে তোলা হয়।

 

ঘটনাস্থলে ডিআইজি

গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে প্রায় ঘন্টা ব্যাপী নির্যাতিতা ওই নারী, তার বাবা ও স্বামীর সাথে বেগমগঞ্জ থানায় কথা বলেন ডিআইজি।

পরে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ডিআইজি বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। ঘটনায় ভিকটিম বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ থানায় পৃথক দু’টি মামলা করেছেন। ভিকটিমের ভাষ্য অনুযায়ী অভিযুক্ত যুবকরা তাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতো। তিনি স্থানীয় ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেমকে বিষয়টি জানালেও সে কোন ব্যবস্থা নেননি বা পুলিশকেও জানাননি। ইতোমধ্যে মামলায় এজাহারভূক্ত ৪ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও ভিকটিমের দেওয়া আদালতে ২২ধারা জবানবন্দিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগের নাম আসায় গতরাতে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মামলায় কেন দেলোয়ারের নাম আসেনি এমন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, মামলায় ভিকটিম নয় জনের নাম উল্লেখ করেছেন। এর বাহিরে দেলোয়ার ও ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত ছাড়াও ঘটনার তদন্তে যাদের নাম উঠে আসবে তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। অভিযুক্ত অপর আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। পরে তিনি ভিকটিমের বাড়ী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এসময় উপস্থিত ছিলেন, নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন, বেগমগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান শেখ প্রমুখ।

 

এমপি কিরণের সংবাদ সম্মেলন

গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও প্রচারের কান্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। গতকাল উপজেলার দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ কিরণ। এ সময় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের কেউ গৃহবধৃকে নির্যাতনের সাথে জড়িত থাকলে আমরা তদন্ত করে দলীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। যারা এ ধরণের অপকর্ম করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে এবং যারা অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় তাদের বিরুদ্ধেও দল ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, দেলোয়ার আমার নামে যে পোস্টার ছাপিয়েছে, সেটি অনলাইনে তৈরি করা হয়েছে। আমি কখনো সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিই না।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by