বাংলাদেশ

রিজার্ভে স্বস্তি ফিরছে

  প্রতিনিধি ১ এপ্রিল ২০২৩ , ৩:৫৬:০৯ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্ক :
দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে এখন প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স। দেশের ডলারের অস্থির বাজারে স্বস্তিও আনছে খাত দুটি। সেই সঙ্গে ক্ষয়িঞ্চু রিজার্ভেও স্বস্তি আসছে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের কল্যাণে। একদিকে তৈরি পোশাকের সর্ববৃহৎ বাজার ইউরোপে পোশাক রফতানির উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং রোজা ও সামনে ঈদ থাকায় রেমিট্যান্স আহরণেও বেশ ভালো উল্লম্ফন হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স আশা জাগাচ্ছে অর্থনীতিতে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রোজার মাস হওয়ায় মার্চে রেমিট্যান্স আহরণ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীরা এ উপলক্ষে দেশে পরিবারের কাছে বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন এখন। গড়ে প্রতিদিন এখন প্রবাসী আয় আসছে ৭১৩ কোটি টাকার বেশি। মার্চের ৩০ তারিখ পর্যন্ত বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। এ হিসাবে দৈনিক গড়ে এসেছে ৬ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ৭১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অথচ গত মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে মার্চে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে ৪৪ কোটি ডলার। গত বছরের মার্চে দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬ কোটি ডলারের মতো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সময়ের আলোকে বলেন, আগের মাস ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে প্রবাসী আয়ে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২৮ মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ১ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। গত ২৯ ও ৩০ মার্চের হিসাব ধরলে এ মাসে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া এখন রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ৩১ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে রয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। সুতরাং ধীরে ধীরে রিজার্ভ বাড়ছে, সংকটও কাটছে। সামনে ঈদ রয়েছে। সুতরাং এপ্রিলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে, যা অর্থনীতির জন্য আরও স্বস্তির বারতা নিয়ে আসবে।

তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ডলারের হোল্ডিং বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের হোল্ডিং ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলা নিয়ে যে জটিলতা ছিল এখন সেটিও কমে আসছে। বলা যায়, ব্যাংকে এখন আর এলসি সংকটের হাহাকার আর নেই।
ইউরোপে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধিতে সবার ওপরে বাংলাদেশ

এদিকে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ৩৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেড়েছে, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। এ সময়ে বাংলাদেশ সেখানে ২২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক হিসেবে নিজেদের অবস্থান বজায় রেখেছে।

ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২২ সালে সারা পৃথিবী থেকে ইইউর পোশাক আমদানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। প্রধানতম রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সেখানে সর্বোচ্চ রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুসারে শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক দেশ চীন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানি বেড়েছে ১৭.১ শতাংশ। ২০২২ সালে চীন থেকে ইইউর আমদানি ছিল ৩০ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। ইইউর তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক আমদানির উৎস তুরস্ক থেকে পোশাক আমদানি ১০.০৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমদানি ১১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভারত ও ভিয়েতনাম থেকে ইইউর আমদানি যথাক্রমে ২১.০২ এবং ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ইউরোপে পোশাক রফতানির পরিমাণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ইউনিট প্রাইস বৃদ্ধিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সামগ্রিকভাবে ২০২২ সালে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেশ ভালো ছিল। কিন্তু ওই বছরের প্রথম ৬ মাস (জানুয়ারি-জুন) যেভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা গেছে, পরবর্তী ৬ মাসে তা অনেকটাই কমে এসেছে। এর মূল কারণ প্রথম ৬ মাস ছিল কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়। ফলে ক্রেতারা বেশি করে তখন পোশাক কিনেছে। এ ছাড়া চীনে লকডাউন থাকায় তখন আমরা ভালো করেছি। তিনি বলেন, পরবর্তী ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পোশাকের চাহিদা কমতে শুরু করে। এর প্রভাব আমাদের রফতানিতেও পড়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা এখন ইইউতে রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, ‘রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে ভালো প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য স্বস্তির খবর। তবে এ ধারা অব্যাহত রাখতে রফতানি বাণিজ্য যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়ানোর জন্য হুন্ডি প্রতিরোধে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তা হলে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে বাধ্য হবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চায় বিজিএমইএ
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা তুলা দিয়ে বানানো তৈরি পোশাক আবার দেশটিতে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে বিজিএমইএ। সম্প্রতি তৈরি পোশাক খাতের রফতানিকারকদের সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে এ বিষয়ে চিঠি দেন। রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট ও সেনেটর টেড ক্রুজকেও প্রায় অনুরূপ চিঠি দিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি। এতে উভয় দেশের যেসব লাভ হবে সেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে পোশাক তৈরির প্রধান কাঁচামাল তুলার বড় অংশই বাংলাদেশ আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর ২০২২ সালে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা পোশাকের মধ্যে ৭১ শতাংশ কটন বা তুলা থেকে তৈরি। এ কারণে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হলে উভয় দেশেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে চিঠিতে তুলে ধরা হয়।

বিজিএমইএ চিঠিতে পোশাক রফতানি ও তুলা আমদানির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে লিখেছে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৯.৭৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করা হয়। এর ৭১ শতাংশ বা ৬.৯১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক তুলা দিয়ে তৈরি। অপরদিকে বাংলাদেশের আমদানি করা তুলার বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশের বন্দরে তুলা আমদানি করার পর জীবাণুমুক্ত করার প্রক্রিয়া ফিউমিগেশন সহজ করা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আলোচনা চলছি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ প্রক্রিয়ার শর্ত কিছুটা শিথিল করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশও করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন ফারুক হাসান।

ফারুক হাসান চিঠিতে লেখেন, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে বাংলাদেশি পোশাক প্রবেশের জন্য দেশটির আমদানিকারকরা ১৫৫ কোটি ডলারের শুল্ক দিয়েছেন। দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাকের শুল্ক অনেক বেশি।
এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলায় তৈরি করা পোশাক দেশটিতে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাওয়া হয়েছে চিঠিতে। এ সুবিধা পাওয়া গেলে উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা আরও বাড়বে। দেশটির তুলা উৎপাদকরও লাভবান হবেন। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা বিশেষ করে সীমিত ক্রেতারা কম দামে পোশাক কিনতে পারবেন।

Powered by