বিনোদন

নায়ক হারানো ২৫ বছর

  প্রতিনিধি ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৩:৪৬:৩৮ প্রিন্ট সংস্করণ

আজ ৬ সেপ্টম্বর চিত্রনায়ক সালমান শাহর ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যূর সময় তাঁর নিজের বয়স ছিল ২৫। ক্যারিয়ারের মাত্র ৪। অভিনীত ছবির সংখ্যা ২৭। মৃত্যুর ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও কী বিস্তৃত তাঁর প্রভাব! এখনো তাঁর তারকাখ্যাতি সমুজ্জ্বল। সালমান শাহ-পরবর্তী সময়ে যারা চলচ্চিত্রে নায়ক হওয়ার জন্য এসেছেন তাঁদের অনেকের কাছেই সালমান শাহ ছিলেন অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস। সালমানকে বলা হতো ৯০ দশকের সেরা নায়ক।

গায়ক থেকে হয়ে ওঠা নায়ক

সালমান শাহ মানেই আমাদের কাছে ছেলেমানুষীভরা, হাস্বোজ্জল এক সফল নায়কের ছবি। অভিনয়ে আসার আগে সালমান নিজেও খুব করে চাইতেন অভিনেতা হিসেবে নাম কুড়াতে। নায়ক হতে। ছোটবেলা থেকেই তাই টুকটাক বিভিন্ন কাজে তাঁর অংশগ্রহণ দেখি। কিন্তু এটাও সত্যি যে, প্রথম জীবনে সালমান শাহ গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে সেভাবেই নিজেকে গুছিয়েছিলেন সালমান। বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা ঘরোয়া আয়োজনে গাইতেনও তিনি। ১৯৮৬ সালে ছায়নট থেকে পল্লীগীতিতে উত্তির্ণ হয়েছিলেন সালমান। বন্ধুমহলে তাই পরিচিত ছিলেন গায়ক হিসেবেই। পরবর্তী জীবনে সালমান যখন নায়ক হয়ে ভক্তদের মনে স্থায়ী আসন গেড়েছেন, তখনো তার গায়কসত্ত্বা থেমে থাকেনি। ‘প্রেমযুদ্ধ’ ও ‘ঋণশোধ’ নামের দুটি ছবিতে নিজকণ্ঠে গেয়েছেন গান। শুধু তাই নয়, হানিফসংকেতের একটি অনুষ্ঠানে সালমানের আত্মপ্রকাশও একটি গানের মাধ্যমে। তবে সেই গানে তিনি কণ্ঠ দেননি। মডেল হয়েছেন। তখনো সালমান ইমন নামেই পরিচিত।

সালমান শাহসালমান শাহ। ছবি: সংগৃহীত সালমান ফ্যাশন

ভক্তরা তার প্রিয় নায়ক বা নায়িকাকে ফলো করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে কেউ কেউ পারেন ট্রেন্ড তৈরি করতে। সালমান যেমন পেরেছিলেন। সালমান যখন মাথায় স্কার্ফ বাঁধতে শুরু করলেন, গোটা যুবসমাজের কাছে যেন সেটা এক ফ্যাশন আইকন হয়ে উঠল। এছাড়া, কোনো ছবিতে মাথায় ওয়েস্টার্ন হ্যাট চাপিয়ে দেওয়া, কোনো ছবিতে চোখে লেন্স পরে নিজের চাহনি বদলে ফেলা, এমনি নানা রকম পোশাক আশাকে সালমান যেন এক বিস্ময়কর নায়কের পরিণত হয়ে গেলেন। তার কথা বলার ধরন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই যেন ভক্তদের অনুকরণীয় হয়ে উঠছিল। আসলে সালমান ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা ফ্যাশন সচেতন এক নায়ক।

২৫ বছরের শোক

কথায় বলে শোকের বয়স তিনদিন। মাাহপুরুষদের বেলায় সেটা মাস পেরোয়, বছর পেরোয়। কিন্তু সালমানের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে ২৫টি বছর। দুই যুগেরও বেশি সময়। এখনো কাটেনি ভক্তদের শোক। এখনো সালমানের মৃত্যুদিন কিংবা জন্মদিনে টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা, বিভিন্ন সংগঠনসহ নানা মাধ্যমে সালমান স্মরণে থাকে বিশেষ আয়োজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো প্রায় সারা বছরই সালমানভক্তদের নানা মন্তবে মুখর থাকে। সালমানের মৃত্যূ নিয়ে বছরের পর বছর চলমান মামলা কিংবা তদন্তের কারণে সালমানের মৃত্যুরহস্য আজো যেন ‘শেষ হইয়াও হয় না শেষ’। সালমান শাহর মৃত্যুর পর প্রায় ২৫জন ভক্তের আত্মাহুতির খবর শোনা যায়। কথিত আছে সেই সংখ্যাটা নাকি আরো বেশি। অথচ সালমানের চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার মাত্র চার বছরের। এত স্বল্প পরিসরের ক্যারিয়ারে এতটা জনপ্রিয়তার নজির যেমন বিরল, তেমনি কোনো নায়কের মৃত্যুতে এত ভক্তের আত্মাহুতির ঘটনাও এক ইতিহাস। সালমানের মৃত্যুর সময়ের যুবক ভক্তটি আজ মধ্যবয়স ছুঁইছুঁই। সেদিনের কিশোর আজ আধুনিক চলচ্চিত্র দেখায় অভ্যস্ত। অথচ তাদের মনে সালমানের ছবিটা আজো অবিচল। আজো সালমানের মৃত্যু বাংলা ছবির জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

সালমান শাহসালমান শাহ। ছবি: সংগৃহীত বিকল্প সালমান

সালমান শাহ যখন মারা গেলেন, তখন তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সালমানের ছবি মানেই হিট। স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের নিদেনপক্ষে একটা দিনের ক্লাস মিস করে হলে ছোটা।

হুট করেই চলে গেলেন সালমান। কি হবে অসমাপ্ত ছবির? প্রযোজকদের সামনে লাভ্যাংশের পরিমাণ আকাশচুম্বী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। ভক্তরা প্রিয় নায়ককে দেখতে চান আরো একবার। ঘোষণা আসতে শুরু করল ‘সালমান শাহ অভিনীত শেষ ছবি’র। অসমাপ্ত ছবি শেষ করতে চারদিকে ‘খোঁজখোঁজ’ রব পড়ে গেল সালমানের বিকল্পের সন্ধানে। কমপক্ষে দশজনের মতো ‘ডামি সালমান’ বা বিকল্প সালমানের খবর আসল। কেউ পেছন থেকে দেখতে সালমানের মতো। কেউ চলনে বলনে সালমানের মতো। কেউ আবার সমানা সামনিই দেখতে সালমানের মতো। কোনো নায়কের মৃত্যূর পর এত ‘ডামি নায়ক’-এর চাহিদা আগে দেখেনি কেউ। বিকল্প সালমান নিয়ে অসমাপ্ত ছবি সম্পন্ন করতে উঠে পড়ে লাগেন নির্মাতা প্রযোজকরা। সালমানের বিকল্প হিসেবে এসে পুরো দস্তুর নায়ক হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন শাকিল খান।

সহশিল্পী শাবনূর ও মৌসুমী

সালমান-শাবনূর ছিল ওই সময়ের সফল জুটি। সালমানের মৃত্যুর পর অনেকেই শাবনূরের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ককে দায়ী করেছেন। অথচ, সালমান বলেছিলেন শাবনূর তার ‘পিচ্চি বোন’-এর মতো। আর শাবনূর বলেছিলেন সহশিল্পী হিসেবে সালমানের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়াটা চমৎকার। তবে সালমানের মৃত্যুর পর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চাইতেন না শাবনূর।

সালমান শাহসালমান শাহ। ছবি: সংগৃহীত সোহানুর রহমান সোহানের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় সালমান শাহ ও মৌসুমীর। দুজনে কেবল চলচ্চিত্রেই সহল্পীই ছিলেন না। খুলনা বয়রা মডেল হাই স্কুলে দুজনে সহপাঠীও ছিলেন। দুজনের এই বন্ধুত্বে ভাটা পড়ে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। বরিশালে একটি সিনেমার কাজে গিয়েছিলেন তাঁরা। হোটেলে গিয়ে দেখা গেল দুজনের রুমের একটাই এটাচড বাথরুম। তা নিয়ে দুজনের মাঝে বাক বিতন্ডা হয়। সেই থেকে আর একসঙ্গে দেখা যায় না সালমান শাহ ও মৌসুমীকে। তবে সালমান মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে সেই সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায় তাঁদের।

মৃত্যুর সেই দিন

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সকালে সালমানের বাবা তাঁর বাসায় গেলে নিচে দারোয়ান বলেন, ‘স্যার, এখনতো উপরে যেতে পারবেন না। কিছু প্রবলেম আছে। আগে ম্যাডামকে (সালমান শাহ’র স্ত্রী সামিরাকে) জিজ্ঞেস করতে হবে।’ এক পর্যায়ে সালমানের বাবা জোর করে উপরে গিয়ে সামিরাকে বলেন, ‘ইমনের (সালমান শাহ’র ডাক নাম) সাথে কাজ আছে, ইনকাম ট্যাক্সের কাগজে সই করাতে হবে।’ সালমানের মা নীলা চৌধুরীর ভাষ্যমতে, সালমানের বাবাকে দেড় ঘণ্টার মতো বসিয়ে রাখা হয়। বেলা এগারোটার দিকে ফোন আসে সালমানের মা নীলা চৌধুরীর বাসায়। বলা হয়, সালমান শাহকে দেখতে হলে তখনই যেতে হবে। টেলিফোন পেয়ে নীলা চৌধুরী ছোটেন সালমানের বাসার দিকে। সালমানের ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে ছেলে সালমান শাহকে বিছানার ওপর দেখতে পান নীলা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সামিরার পার্লারের কিছু মেয়ে ইমনের হাতে-পায়ে সর্ষের তেল দিচ্ছিল। আমি ভেবেছি ইমন ফিট হয়ে গেছে। আমি দেখলাম আমার ছেলের হাতে পায়ের নখগুলো নীল। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, আমার ছেলে তো মরে যাচ্ছে।’

সালমান শাহসালমান শাহ। ছবি: সংগৃহীত ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমান শাহকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানকার ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। সালমানের মৃত্যুর খবরে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা দেশ, পুরো চলচ্চিত্র জগৎ। কেউ যেন বিশ্বাসই করতে চাইছলেন না সালমান নেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে বলা হয় সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন।

একনজরে

জন্ম: ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আসল নাম: চৌধুরী সালমান শাহরিয়ার ইমন

বাবা: মরহুম কমর উদ্দিন চৌধুরী

মা: নীলা চৌধুরী

স্ত্রী: সামিরা

উচ্চতা: ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি

প্রথম চলচ্চিত্র: কেয়ামত থেকে কেয়ামত

প্রথম ছবির নায়িকা: মৌসুমী

সর্বাধিক ছবির নায়িকা: শাবনূর

মোট ছবি: ২৭টি

কয়েকটি ছবির নাম: আনন্দ অশ্রু, স্বপ্নের নায়ক, স্বপ্নের ঠিকানা, অন্তরে অন্তরে, সত্যের মৃত্যু নেই, এই ঘর এই সংসার,

বিজ্ঞাপনচিত্র: মিল্কভিটা, জাগুয়ার কেডস, গোল্ডস্টার টি, কোকাকোলা, ফানটা

ধারাবাহিক নাটক: পাথর সময় এবং ইতিকথা

একক নাটক: আকাশ ছোঁয়া, দোয়েল, সব পাখি ঘরে ফেরে, সৈকতে সারস, নয়ন ও স্বপ্নের পৃথিবী

মৃত্যু: ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬

আরও খবর

Sponsered content