বরিশাল

অ্যাম্বুলেন্সে করোনা রুগী বহন করায় খাবার হোটেলে প্রবেশ নিষেধ

  প্রতিনিধি ৩০ জুন ২০২০ , ৬:৫৭:২৫ প্রিন্ট সংস্করণ

অ্যাম্বুলেন্সে করোনা রুগী বহন করায় খাবার হোটেলে প্রবেশ নিষেধ

ঝালকাঠি প্রতিনিধি : ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের করোনা দায়িত্বে নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স চালক মোঃ আনোয়ার হোসেন তার হতাশার কথা প্রকাশ করলেন সাংবাদিকদের কাছে।
অ্যাম্বুলেন্সে করোনা রোগী বহন করছি এজন্য হোটেলে খেতে গেলে একবার খেয়ে আসলে দ্বিতীয়বার ওই হোটেলে আর না যাবার জন্য নিষেধ করে দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। অতিপ্রয়োজন হলে বাইরে দাড়িয়ে খাবার চাইলে পার্সেল প্যাক করে দিবে তবুও হোটেলে ঢোকা যাবে না। আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মীরাও এখন আমাকে এড়িয়ে চলে যাতে তাদের সংস্পর্শে আমি না যাই।

নতুন চাকরীর প্রথম পোস্টিং ১শ শয্যা বিশিষ্ট ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। চাকুরীতে যোগদানের পরে কর্মস্থলের প্রতিটি দিনই নতুন নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে হচ্ছে। তবে মিষ্টি অভিজ্ঞতা একটিও নেই বলে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, চাকুরীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার পুরোটাই তিক্ত অভিজ্ঞতা। তবে এতো ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ একদিন তাকে পুরস্কৃত করবেন সেই আশায় বুক বাধি। এসব কথা জানান ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে করোনা রোগী ও নমুনা বহন কাজে নিয়োজিত একমাত্র অ্যাম্বুলেন্স চালক মোঃ আনোয়ার হোসেন।তিনি মাগুরা সদর উপজেলার মহিষাডাঙ্গা গ্রামের মোঃ শাহাবুদ্দিন বিশ্বাসের পুত্র। মাগুরার একটি কামিল মাদ্রাসা থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তিনি।

করোনা রোগী শনাক্ত হলে ওই এলাকায় সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে আক্রান্ত ব্যক্তিসহ পরিবার ও আশপাশের এলাকাকে অবরুদ্ধ করে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ। মরণব্যধি করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের উন্নত ও সুচিকিৎসার জন্য জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাম্বুলেন্স চালক।

অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, চাকুরীর প্রথম পোস্টিং ঝালকাঠিতে। চলতি বছরের ১৫ফেব্রয়ারী ঝালকাঠি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে যোগ দেই। সেখান থেকে তাকে পোস্টিং দেয়া হয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। ২৮ মার্চ ঝালকাঠির তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশের মাধ্যমে করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ আসে।

সরকারী নির্দেশনা আসায় করোনার দায়িত্ব পালনে ভয় পেলেও মানবিকতার দায়িত্ববোধ থেকে নির্দেশ পালনের বিষয়ে কোন আপত্তি করিনি। এ কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাকুরী জীবনের শুরুতেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন অ্যাম্বুলেন্স চালক মোঃ আনোয়ার হোসেন।

অ্যাম্বুলেন্স চালক মোঃ আনোয়ার হোসেন জানান, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে পোস্টিং দেয়ার পর থেকে নেই কোন আবাসন সুবিধা। খাবারেরও কোন ব্যবস্থা করা হয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। করোনা রোগীদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চলাচলের কারণে বাহিরের কোন ম্যাচেও ভাড়া থাকতে পারছেন না। আরেক সহকর্মীর (অ্যাম্বুলেন্স চালক মহসিন) বাসায় থাকছেন। খাবারের ব্যবস্থা হিসেবে বাহিরের হোটেলে সুযোগ বুঝে খেয়ে নিতেন।

নারায়নগঞ্জ থেকে আসা পুলিশের এসআই আমিনুল ইসলামের করোনা সংক্রমণের নমুনা নিয়ে ২ এপ্রিল ঢাকা মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যাওয়া হয়। ইতিমধ্যে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাধ্যমে বরিশাল বিভাগের করোনা সংক্রমণের নমুনা মহাখালীতে প্রেরণের সুযোগ চালু হয়। এরপর থেকে ঝালকাঠি হতে করোনা সংক্রমনের নমুনা নিয়ে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিয়ে আসতে শুরু করেন। ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৫ জন করোনা পজিটিভ ব্যক্তিকে ঝালকাঠি থেকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌছে দেন তিনি।

করোনা পজিটিভ থাকা মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন পাটোয়ারীকে ২৩ জুন বরিশালে নিলে সেখানেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ২২ জুন শহরের পশ্চিম চাঁদকাঠি এলাকার সাবেক কাউন্সিলর মোফাজ্জেল হোসেনের করোনা পজিটিভ থাকা অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বরিশাল শের-ই বাংলা হাসপাতালে পৌছে দিলে তিনিও সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ এখন পর্যন্ত করোনা পজিটিভ চিহ্নিত ৫ জনকে বরিশালে অ্যাম্বুলেন্সে করে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নিয়ে বরিশালে যেতে হয়।

দুঃখ প্রকাশ করে অ্যাম্বুলেন্স চালক আনোয়ার জানান, করোনা রোগীদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে জনসাধারণ ক্রমান্বয়ে আমাকে চিনতে থাকে। সামাজিক বিচরণের ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আত্মীয় এবং সহকর্মীরাও আমাকে অনেকটা এড়িয়ে চলে। মঙ্গলবার রাতে হোটেলে ঢুকে খাবার খেয়ে বের হবার সময় হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাকে আর হোটেলে না যাবার জন্য বলে দিয়েছে। খাবারের বেশি প্রয়োজন হলে হোটেলের বাহিরে দাড়িয়ে অর্ডার দিলে তারা পারসেল দেয়ার কথা বলেছে। তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছে।

সদর হাসপাতালের আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক মহসিন জানান, আমরা অনেক ধরনের রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ঢাকায় নিয়ে থাকি। কার মধ্যে কোন ভাইরাস আছে তা জানি না। দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার কারণে অপারগতাও প্রকাশ করতে পারছি না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের তেমন কোন নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি দেয় না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা দেয় তা আবার স্টোর কিপার কমিয়ে দেয়। জীবনের ঝুকি নিয়ে প্রতিটা মুহুর্তে দায়িত্ব পালন করতে হয়

একই অভিযোগ করলেন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের অ্যাম্বুলেন্স চালক মোঃ কাওছার হোসেন। তিনি জানান, প্রতিদিন গর্ভবতি মাসহ জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ রোগীদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে হয়। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে। কখন যেন আমি আক্রান্ত হচ্ছি আবার আমার মাধ্যমে পরিবারের স্ত্রী-সন্তানসহ সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা সামগ্রীও পাচ্ছি না। যা পাচ্ছি তাতে স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরেও সরকারী দায়িত্ব এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সেবা দিতে হচ্ছে।

তারা উভয়েই আনোয়ার হোসেনের মতোই ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, বাহিরের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মীরাও আমাদের এড়িয়ে চলেন। আমাদের সাথে সবার আচরণ এমন ধরনের যা দেখলে মনে হয় আমরা নিজেরাই করোনা। এজন্য মাঝে মধ্যে মানুষিক কষ্ট পেলেও সেবা দিয়ে আত্মতৃপ্তি উপভোগ করি।

ঝালকাঠির ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডাঃ আবুয়াল হাসান জানান, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে করোনায় নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স চালকের নিরাপত্তা সরঞ্জাম যখনই প্রয়োজন হয় তখনই তার চাহিদা মতো সরবরাহ করা হয়। তাকে থাকার জন্য পুরাতন ভবনের একটি কক্ষ দিয়েছি। এছাড়াও অন্যান্য অ্যাম্বুলেন্স চালকের জন্য আমরা নিরাপত্তা সরঞ্জাম দিয়েছি।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by