ঘটনাবলি

বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে মাইক্রোপ্লাস্টিক, গবেষণায় উঠে এলো ভয়ঙ্কর তথ্য!

  প্রতিনিধি ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ , ৮:১১:২২ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্ক:

বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেনের গবেষণায়।

প্লাস্টিকের অংশ ভেঙে ছোট ছোট আকারে পরিণত হলে পাঁচ মিলিমিটার পর্যন্ত মোটা টুকরোগুলোকে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সম্প্রতি তার গবেষণার ফলাফল ‘Abundance and characteristics of microplastics in sediments from the world’s longest natural beach, Cox’s Bazar, Bangladesh’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক জার্নাল মেরিন পলুশন বুলেটিন এ প্রকাশিত হয়েছে।

বঙ্গোপসাগর উপকূলে অবস্থিত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক বালুময় সৈকত, পাহাড়-টিলা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গভূমি। এই নগরটি বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় বিশ লক্ষ পর্যটক এই সৈকতটি দেখতে আসেন। ফলে সমুদ্র সৈকতের হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং পর্যটকদের অসচেতনতায় প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিকের বর্জ্য তৈরি হয়, যা প্রায়শই সৈকতে দেখা যায়।

গবেষণা লব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, খাদ্যচক্র ও খাদ্যসুরক্ষায় মারাত্মক হুমকির কারণ। তা উপলদ্ধি করে এই বিষয়ে সমুদ্র তীরবর্তী বিভিন্ন দেশ ব্যাপক গবেষণা সম্পন্ন করলেও আমাদের দেশে গবেষণার সংখ্যা খুবই নগন্য বা নাই বললেই চলে। তাই ২০১৯ সাল থেকে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে এই গবেষণা শুরু করা হয়।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় ড. বেলাল হোসেন এর সাথে যুক্ত ছিলেন একই বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী পার্থ বণিক, আস-আদ উজ্জামান নূর এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী তুরাবুর রহমান।

এই বিজ্ঞানী দল ২০১৯ সালের প্রাক-পর্যটন মৌসুমে (আগস্ট থেকে অক্টোবর) বঙ্গোপসাগরের ভাটার সময়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আটটি স্পট থেকে মোট ২৪টি সামুদ্রিক পলল নমুনা সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত নমুনাগুলো অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করেন। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্র সৈকতের তুলনায় এখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রাচুর্যতা বেশি।

কম উৎপাদন খরচ, ব্যবহারের সুবিধা, হালকা কিন্তু মজবুত হওয়ায় বিশ্বে নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে শিল্পদ্রব্য, ফার্মাসিউটিক্যাল ও অন্যান্য উপাদান তৈরিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। শুধু ২০১৮ সালেই সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের বিভিন্ন বাস্তুসংস্থানে পাওয়া যায়, এমনকি এভারেস্টের চূড়াতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকে সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভিন্ন বর্জ্য প্লাস্টিক সামুদ্রিক জঞ্জাল বা বর্জ্য হিসেবে কোন না কোন ভাবে সমুদ্রে গিয়ে জমা হয়। বড় আকারের প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের ঢেউ, সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির জারণ প্রভাবে, কিংবা জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে গিয়ে অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা তথা মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা থেকে পলিব্রোমিনেটেড ডি-ফেনাইল ইথার (পিবিডিই), বিসফেনল এ, ফ্যালেট সহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এগুলো নানাবিধ ক্যান্সার এবং প্রজননজনিত রোগের কারণ হতে পারে। এই বিপজ্জনক পদার্থগুলো খাদ্য শৃঙ্খলের বিভিন্ন স্তরে যেমন- জুপ্ল্যাঙ্কটন, ঝিনুক, কৃমি, ক্রাস্টেসিয়ান, প্রবাল, মাছ এবং সামুদ্রিক পাখিতে জমা হতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ২৪টি মাটির নমুনায়ন করে তা অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ পূর্বক দেখা যায় পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্র সৈকতের তুলনায় এখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রাচুর্যতা বেশি যা সৈকতটি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দ্বারা দূষিত তা প্রমাণ করে। যেহেতু মাইক্রোপ্লাস্টিকের পুনঃচক্রায়ন খুবই দীর্ঘ বা হয় না সেহেতু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ না করলে এই দূষণ বাস্তুসংস্থান ও খাদ্যচক্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

গবেষক দলের প্রধান ড. বেলাল হোসেন জানান, যেহেতু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে খুবই অল্প গবেষণা হয়েছে, তাই এই বিষয়ে আরো ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। শুধু সামুদ্রিক পরিবেশেই নয়, অভ্যন্তরীণ মিঠা পানির জলাশয়েও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। এছাড়াও বিভিন্ন সামুদ্রিক ও স্বাদু পানির প্রাণি যেমন- কমন ফিস, শেলফিস, গেস্ট্রপোড, বাইভালভ এর মাঝেও এদের উপস্থিতি পর্যালোচনা করা অতীব জরুরি।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সৈকত কুয়াকাটার পলি নিয়ে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি, নোয়াখালীর  বিভিন্ন স্বাদু পানির পুকুর থেকেও নমুনা সংগ্রহ করেছেন। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে তিনি মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে যে সকল ক্ষতিকর পদার্থ যেমন- পিসিবি, পিএএইচ ইত্যাদি ক্ষরিত হয়, পরিবেশে তাদের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কাজ করবেন বলে জানান।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by