চট্টগ্রাম

বাংলা আমার অহংকার : রাষ্ট্রভাষা ও মায়ের ভাষা

  ওমর ফারুক ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৪:০০:০৪ প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা আমার অহংকার : রাষ্ট্রভাষা ও মায়ের ভাষা

শিশু কালে মায়ের মুখ থেকে যা শুনেছি তা বাংলা ভাষা। আমার মায়ের ভাষা। মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য দিনের পর দিন বাংলায় কথা বলি। বাংলায় গান গায়। বাংলা নিয়ে অহংকার করি। পৃথিবী ভেবে তাজ্জব হয়ে যায় আমরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। যুদ্ধ করেছি। যারা অদৃশ্য করে দিতে চেয়েছে তাদের উল্টো হারিয়ে দিয়েছি।

আমার মায়ের ভাষার জন্য বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন দিয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্র ও মায়ের ভাষায় রূপ দিয়েছে। পৃথিবীকে চিনিয়েছে আমাদের কথা বলার আলাদা ভাষা আছে। যে ভাষা সহস্র ত্যাগের বিনিময়ে আজ বিশ্বে ঠিকে আছে। আমাদের ইতিহাস নড়াচড়া করলে দেখা যায় অজস্র গর্বের ইতিহাস রয়েছে।

আজ আমরা সেই বাংলা ভাষা সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করব। তথা মায়ের ভাষা সম্পর্কে!নন্দ সাম্রাজ্য, মৌর্য, পাল, মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি কিংবা বাঙ্গাল খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে বর্তমান ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বহুত শাসন এসেছে। এদের ভিতর শাসন করেছেন, গুপ্তবংশ, শশাঙ্ক, চন্দ্র বংশ সেন বংশ এবং দেব বংশ। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার সহ খলজি বংশ, তুর্কো-ভারতীয় তুঘলক বংশ, সৈয়দ বংশ এবং লোদী বংশ একমাত্র মহিলা শাসক “রাজিয়া সুলতানা সহ অনেকেই শাসন করেন পুরো বাংলাকে কিংবা বাংলার আংশিক অংশকে।

লর্ড ক্লাইড, ফজলুল হক, শহিদ সোহরাওয়ার্দী, জিন্নাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শহিদ জিয়া এবং হুসেইন এরশাদ সহ তাঁরাও বাংলাকে পরিচালনা করেন। প্রসান্তের সমপরিমাণ ইতিহাস রয়েছে এই সবুজ বাংলার। তার মধ্যে আমি মনে করার চেষ্টা করব এক চিমটি আমাদের গৌরবময় মায়ের ভাষা রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষাকে। আমাদের অনেক যুদ্ধে হয়েছে। যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে জয়-পরাজয় ভাগাভাগি হয়েই বাংলা আজ এখানে এসে স্থির হয়েছে।

আমাদের ইতিহাস জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতার মত! ❝আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরাডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!❞১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন করাচি থেকে ঢাকায় আসেন।

তিনি পল্টন ময়দানে জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেন, ❝প্রদেশের সরকারি কাজকর্মে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু।❞ তাঁর বক্তব্য শুনে মুহূর্তেই বাংলায় ঝড় নেমে আসে ছাত্রসমাজে। রাজপথে নেমে পড়ে এবং “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন। একই মাসে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়।

অপর দিকে ৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সকল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের এক সভায় “সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক বানানো হয়। পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব পেশ করেছিল। কিন্তু তাৎক্ষণিক এই কথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো শুরু হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেসব কর্মসূচির আয়োজনের সময় পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

তবে ভাষার উপর চরম আক্রমণ ১৯৫২ সালে হলেও ব্রিটিশ শাসন পরাস্ত হওয়ার পরপরই মূলত ভাষার প্রতি আঘাত আসে। ১৯৪৭ ইংরেজ বিদায় নিলে পাকিস্তান ভারতের সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান গঠিত হলে পশ্চিমারা পূর্বের উপর একের পর একে আঘাত আনতে থাকে। ১৯৪৭-৫২ পর্যন্ত বাংলা ভাষা দূর করার লক্ষ্য এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত না দিয়ে উল্টো বাংলা ভাষাকে চিরতরে হারিয়ে দিতে চেষ্টা করছিল।

উর্দুকে মূল রাষ্ট্রভাষা করে শান্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলার সকল জনতা তা হতে দেয়নি। আমরাই সম্ভবত একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্যও অনেক জীবন দিয়েছি। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করতে বহু নিপীড়ন সহৃ করতে হয়েছে।সেই অজস্র ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের সুমধুর ভাষাকে ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্বকে চমকে দেয়। ১৯৪৮ সালে আগস্ট মাসে পাকিস্তানের সৃষ্টি। সেই বছরের নভেম্বর থেকেই তারা ভাষায় বৈষম্য শুরু করে।

উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় ট্রেনের টিকেট, খাম, পোস্ট কার্ড, ডাকটিকেট, ফর্ম ও মানি অর্ডার ইত্যাদি সব ছাপা শুরু করে। ৪৭ সালে ডিসেম্বরে পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার জন্য একটা প্রস্তাব গৃহীত হয়। মর্নিং নিউজে এই খবর প্রকাশিত হয়। তখন থেকে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ শুর করে। ডিসেম্বর ছয় তারিখে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ইত্যাদি সহ শিক্ষার্থীরা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে।

সভায় সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম। মুনীর চৌধুরী, এ.কে.এম আহসানসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি ফরিদ আহমদ। এটাই সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্র সভা রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। একে একে অনেকবার ভাষার প্রতি পাকরা আক্রমণ করে।

২১ মার্চ ১৯৪৮ রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ❝উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি অন্য পথে চলবে সে পাকিস্তানের শত্রু।❞ তাঁর বক্তব্যের বিপক্ষেও ছাত্রসমাজ বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলে পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৮ সালে নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাকে একটি মানপত্র দিয়ে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান ছাত্ররা।

১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এই কমিটি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সর্বশেষ ১৯৫২ সালে বিশাল রক্তপাত ঘটান পাকিস্তান সরকার। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন শুরু হলে মিছিলে অস্ত্র চালিয়ে বাংলার অনেক সন্তানকে হত্যা করে। এই দিন ভুলবার নয়। মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করতে অনেক চড়াই-উতরাই এর মাঝ দিয়ে আসতে হয়েছে। এত আঘাত হানবার পরও বাংলা মায়ের ভাষা মাতৃভাষা টিকে আছে।

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে। সেদিন মিছিল হওয়ার পূর্ব থেকেই ঢাকার রাস্তায় পুলিশ জমা হতে শুরু করে। এক সময় ছাত্র সমাজ ও বাংলার জনগণ ভাষার দাবিতে মাঠে নামলে পুলিশ অনবরত গুলি চালাতে থাকে। ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ে পরিণত করে পাকিস্তান সরকার। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় মিছিল হয়।

পুলিশের গুলিতে শহিদ হয় রফিক, শফিউর, জব্বার, বরকত ও সালাম। যদিও সে সময় উভয় পাকিস্তানের ৫৪% জনগণ বাঙালি ছিল। সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও পাকরা আমাদের স্বীকৃতি দেয় নাই। তার ফল শ্রুতিতে বাংলায় নেমে আসে আন্দোলন মিছিল উত্তপ্ত রাজপথ! বিজয়ী করে ফিরিয়ে আনে রাষ্ট্রভাষা মায়ের ভাষা বাংলাকে।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by