রংপুর

দিনমজুর জিয়াউর রহমান এখন শিক্ষা ক্যাডার

  প্রতিনিধি ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৪:০৬:৫১ প্রিন্ট সংস্করণ

দিনমজুর জিয়াউর রহমান এখন শিক্ষা ক্যাডার

অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর কঠোর পরিশ্রম করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন মেধাবী শিক্ষার্থী জিয়াউর রহমান। উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪১ তম বিসিএস সুপারিশ প্রাপ্ত শিক্ষা ক্যাডারে। পড়াশুনা চালিয়ে নেয়ার সামর্থ্য ছিল না। ফরম পূরনের টাকা ছিল না, টাকার জন্য দিনমজুরের কাজ করতে হতো।

অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। অভাবের কারনে জরাজীর্ণ ঘরে এক পাশে গবাদি পশু (গরু ছাগল) অপর পাশে রাত কাটাতে হতো তাকে। সেই জিয়াউর রহমান এখন বিসিএস ক্যাডার। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের বাকারায় মধুপুর দালালীপাড়া গ্রামের ছকিয়ত আলী ও জেলেখা বেগম দম্পতির ছেলে তিনি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, জিয়াউর রহমানের বাবা ছকিয়ত আলী ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মহীন। ৩ শতক জমিতে বসতভিটা। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। শত প্রতিকূলতার মাঝে ২০১২ সালে উপজেলার নতুন অনন্তপুর দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান জিয়াউর রহমান। আলিমে ভর্তি হয়ে অর্থ কষ্টে পড়াশুনা চালিয়ে নেয়ার সামর্থ্য ছিল না তার। পরে বই কেনার টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় যান।

সেখানে একটি দোকানে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু বই কেনা হয়ে উঠে না তার। ছোট বোনের বিয়ের জন্য সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এরপর অর্থের জন্য মুন্সীগঞ্জের আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কিছুদিন কাজ করে পুনরায় বাড়িতে এসে পড়াশোনা শুরু করেন। পড়াশোনার পাশাপশি অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। প্রতিকুলতার মাঝে ধরনীবাড়ী লতিফ রাজিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৪.৬৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।


সরেজমিন বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) জিয়াউর রহমানের বাড়িতে গেলে কথা হয় তার সাথে। তিনি শুরুতেই বলেন, স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির কোচিং করার অর্থ ছিল না। তাই ঢাকায় গিয়ে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি শুরু করি। সেখানে কাজের চাপে পড়াশুনার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ২০১৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ওই বছরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মিরপুর বাঙলা কলেজে সুযোগ পেলেও অর্থের অভাবে ভর্তি হওয়া হয়নি।


তিনি আরও বলেন, ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার, সেভাবে প্রস্তুতিও নেই। কিন্তু ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। পরে ২০১৫ সালে ভর্তি হই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। কিন্তু কীভাবে পড়াশোনার খরচ জুটবে সেই নিশ্চয়তা ছিল না। থাকা, খাওয়া ও সামান্য কিছু হাতখরচের টাকার জন্য খণ্ডকালীন কাজ করি।

এছাড়া টিউশনি, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করে ২০১৯ সালে অনার্সে সিজিপিএ ৩.৪১ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। পরে করোনা মহামারি শুরু হলে আবার আর্থিক সংকটে পড়ি। এরমধ্যেই ২০২০ সালে মার্ষ্টাসে সিজিপিএ ৩.৪৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। শেষে অনেকের সহযোগিতায় ও টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নেই। অবশেষে কপালে জুটে যায় শিক্ষা ক্যাডার। বিসিএসের রেজাল্ট যেদিন প্রকাশ হয় সেদিন শিক্ষা ক্যাডারে নিজের রোলটি দেখে চোখে পানি চলে এসেছিল। তবে ইচ্ছা ছিল প্রশাসনে চাকরি করার। কিন্তু যা হয়েছে তাই নিয়ে অনেক খুশি এখন।


জিয়াউর রহমানের মা জেলেখা বেগম বলেন, ছেলে সংসার চালিয়ে খুব দুঃখ কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। আমরা তাকে কিছুই দিতে পারি নাই। আজ ছেলের ভালো খবরে আমরা সবাই খুশি। তিনি আরও বলেন, ছেলে যখন ফোন করে জানালো ‘মা আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি, তখন বুঝতে পারিনি বিসিএস ক্যাডার কি জিনিস’। পরে বুঝিয়ে বলার পর আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন। সে যেন একজন ভালো মানুষ হতে পারে।


জিয়াউর রহমানের শিক্ষাগুরু অনন্তপুর দাখিল মাদরাসার সাবেক সুপারি মাওলানা আকবর আলী বলেন, জিয়া ছোট থেকেই খুব মেধাবী ছিল। এ কারনে তার শিক্ষা উপকরন, মাদ্রসায় রেজিষ্ট্রেশন ও ফরম পূরনসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করার জন্য আমরা সবাই মিলে সহযোগিতা করতাম। সে শিক্ষা ক্যাডারে সুযোগ পাওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত।


এলাকাবাসী আবুল কাশেম (৮০), সহিদুল ইসলাম (৪৮), ফারুক মিয়া (৩৫)সহ অনেকে বলেন, ছোট থেকেই জিয়া খুবই কষ্ট করে পড়াশুনা করেছে। সে কৃষি কাজের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালিয়েছে। আজ তার সাফল্যে আমরা গ্রামবাসী খুব খুশি।
ধরনীবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এরশাদুল হক বলেন, জিয়াউর রহমান খুবই কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। কখনো দিনমজুর, কখনো টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে পড়াশোনা করে বিসিএস পাস করেছে। সে আমাদের ইউনিয়নের জন্য গর্ব।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by