প্রতিনিধি ২৬ এপ্রিল ২০২১ , ৭:৪১:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ
১৯৯০ কিংবা ১৯৯১ সালে দিকে চাচা খোরশেদ মোল্লার সাথে ঢাকার মুগদা পাড়ায় বেড়াতে আসে মাসুদ। ঢাকা আসার একদিন পর চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে রাস্তায় খেলতে গিয়ে হারিয়ে যায় মাসুদ। ৫/৬ বছরের মাসুদ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তখন নিজের চাচার বাসা আর খুঁজে বের করতে পারেনি। পরিবারের কতো আহাজারি, পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি, ঢাকা শহরের নানান জায়গায় মাইকিং সহ শত চেষ্টা করেও খোঁজ মিলেনি নিখোঁজ মাসুদের। দীর্ঘ তিন দশক পুত্রশোকে ভুগে পরিবারটি।
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার দেওয়ানজীকান্দি গ্রামের বাচ্চু মোল্লার বড় ছেলে মাসুদ। শোকের বিভোর পরিবারের সকল জল্পনা-কল্পনার প্রহর কাটিয়ে আলো হয়ে দীর্ঘ তিন দশক পর ফিরে আসে নিখোঁজ ছেলে মাসুদ। মাসুদকে ফিরে পেয়ে আবেগে আপ্লুত পরিবারটি।
সম্প্রতি জনপ্রিয় রেডিও উপস্থাপক গোলাম কিবরিয়া সরকার (আরজে কিবরিয়া) ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানে নিজের আপন ঠিকানা খুঁজতে আসে মাসুদ। সেখানে এসে নিজের হারিয়ে যাওয়া অতীতের স্মৃতি যতটুকু মনে ছিলো তাই তুলে ধরে মাসুদ।
৫/৬ বছরের বাচ্চা মাসুদ কিছু কিছু স্মৃতি মনে রাখতে পারলেও, মনে রাখতে পারেনি নিজের জন্মস্থান চাঁদপুরের কথা। হারিয়ে যাওয়া পর সে এতটুকুই বলতে পেরেছিলো যে তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া, এবং সে চাচার সাথে লঞ্চে করে ঢাকা এসেছে৷ এরপর হারিয়ে যায় নিজের পরিবার হারানোর ২৯টি বছর।
আরজে কিবরিয়ার অনুষ্ঠান “আপন ঠিকানা” ১৬ নাম্বার এপিসোডে মাসুদ তার পরিবার হারানোর কথা বলে। পরে তা জানতে পারে মাসুদের পরিবার। আরো জানা যায়- মাসুদ যে মা, বাবার কাছে দীর্ঘ এই ২৯ বছর পর্যন্ত থেকেছে যাদের কাছে বড় হয়েছে তার সেই মা, বাবা কেউই বেঁচে নেই।
অনুষ্ঠানটি দেখার পর নানা মাধ্যমে মাসুদের পরিবার যোগাযোগ করে, আরজে কিবরিয়া এবং মাসুদের সাথে। অবশেষে স্টুডিওতে মাসুদের সাথে তার পরিবারকে একত্র করেন আরজে কিবরিয়া। যদিও অনেক প্রমাণ বা তথ্যাদি হাতে পেয়েই গত শনিবার (২৩ এপ্রিল) দীর্ঘ ২৯ বছর পর পরিবারের কাছে মাসুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। মাসুদের ফিরে পায় তার জীবনের ‘আপন ঠিকানা’।
এদিকে, ১৭ বছর আগের এপ্রিল মাসে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে মাত্র ৪ বছর বয়সে হারিয়ে গিয়েছিলেন ছেলে সবুজ। এরপর অনেক খুঁজেও ছেলেকে ফিরে পাননি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার সুচিপড়া গ্রামের বাসার মিয়া (৫৫) ও খোদেজা বেগম (৪২) দম্পতি। দীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষার পর বাবা–মার বুকে ছেলে ফিরে এসেছে আরেক এপ্রিলেই।
জানা যায়, ২০০৪ সালে সবুজ তাঁর দাদা লাল মিয়ার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাতে ফুফু এবং খালার বাসায় বেড়াতে যান। খালার বাসায় কয়েক দিন থাকার পর তাঁরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে ডেমরায় দাদা-নাতির বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
দিনটি ছিল ৪ এপ্রিল, এখনো মনে আছে সবুজের মা-বাবার। ছেলে ফিরে এল আরেক এপ্রিলেই। মাঝে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সবুজ নিখোঁজ ছিলেন। অনুষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, সেদিন হারিয়ে যাওয়ার পর একা বসে বসে সবুজ কাঁদতে থাকেন। তখন এক মুদিদোকানি তাঁকে বাসায় নিয়ে যান। পরদিন তিনি ডেমরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তাঁকে পুলিশের কাছে দিয়ে আসেন।
এদিকে সবুজের পরিবারের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় থানা-পুলিশ ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ নামের একটি এনজিওর কাছে সবুজকে হস্তান্তর করে। এনজিওটি কয়েক মাস তাদের কাছে রেখে সবুজের পরিবারের সন্ধান করে। সন্ধান না পেয়ে আরেক বেসরকারি এনজিও ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’-এর কাছে ২০০৫ সালে হস্তান্তর করে।
ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেনের পরিচালক শিখা বিশ্বাস বলেন, ‘সবুজ অনেক মেধাবী ছাত্র। তাই স্থানীয় স্পনসরের সহযোগিতায় আমরা তাঁকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। বর্তমানে সবুজ সিরাজগঞ্জের বেসরকারি খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে লেখাপড়া করছেন।’
সবুজের মামা রাশেদ আলম বলেন, ‘মা–বাবা তাঁদের হারিয়ে যাওয়া ছেলের সন্ধান পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। লকডাউন শেষে দেখা করার কথা থাকলেও আমরা এর মধ্যেই সবুজের সঙ্গে দেখা করি। পরে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়ি এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেইলসহ অন্যান্য যোগাযোগ আমি করলেও লকডাউনের কারণে ভিড় না বাড়াতে আমি স্টুডিওতে যাইনি। আমার বড় ভাই মাসুদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।’
বর্তমানে সবুজ তাঁর মা–বাবার সঙ্গে চাঁদপুরের বাড়িতে অবস্থান করছেন। গত শুক্রবার মা-ছেলে দুজনই একে অপরকে দেখে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেন। আরজে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ স্টুডিওতে এসময় আবেগঘন একটি মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। রেডিও উপস্থাপক কিবরিয়া হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পেতে সহায়তা চেয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এই অনুষ্ঠান চালু করেছেন।