উপ-সম্পাদকীয়

কাবা ঘরের ইতি কথা ও হযরত মুহাম্মদ  (সঃ) এর দূরদর্শী সমাধান

  প্রতিনিধি ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ , ৫:০৪:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ

কাবা ঘরের ইতি কথা ও হযরত মুহাম্মদ  (সঃ) এর দূরদর্শী সমাধান

সম্মানিত পাঠক বৃন্দ, আজকে আলোচনা করব বাইতুল্লাহ অর্থাৎ কাবা ঘরের ইতিহাস। কাবা ঘর সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘর। কাবা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র। আমাদের কিবলা, কাবাকে সামনে রেখে আমরা নামাজ আদায় করি। হজ্বের সময় কাবার তওয়াফ করা হয়। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ কাবা ঘর। যেখানে এক রাকাত নামাজ আদায় করলে মসজিদে নববী ও মসজিদে আল আকসা ব্যতিত অন্য কোন মসজিদে এক লক্ষ রাকাত নামাজ আদায় করার সওয়াব পাওয়া যায়।(মা’আরেফুল কুরআন) এই ঘরটিই পৃথিবীর সর্ব প্রথম ঘর। যা হযরত আদম (আঃ) নির্মাণ করেছিলেন এবং এই ঘরের রয়েছে অনেক বরকত। ইহা সমগ্র বিশ্ববাসির জন্য হিদায়াত। কুরআনে এসেছে: আল্লাহ তায়ালা বলেন” নিশ্চয় প্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে। তা বাক্কায় (মক্কায়, মক্কার পূর্ব নাম বাক্কা) যা বরকতময় ও হিদায়াত বিশ্ববাসীর জন্য। (সুরা আল ইমরান-৯৬) কি সেই বরকত? প্রিয় পাঠক এই কাবা ঘর যেখানে আছে আজ পর্যন্ত সেখানে খাবারের অভাব হয় নাই। সেখানে অনুর্বর মরুভূমি হওয়া সত্যেও প্রচুর পরিমাণ ফল ফলে, তরিতরকারি যা কিছু প্রয়োজন সব আছে। তা শুধু মক্কা বাসির জন্য না বরং সারা পৃথিবী থেকে সেখানে লোকজন আসে সবার জন্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা তার বরকতে রেখেছেন। সেই কাবা আজও পর্যন্ত রয়েছে। তবে সংস্করণ করা হয়েছে কয়েক বার, কাবা ঘর এপর্যন্ত মোট পাঁচ বার স্থাপন করা হয়েছে। 

সর্ব প্রথমবারঃ কা’বার নির্মাণ কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন হযরত আদম      ( আঃ) কে হযরত জিবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে। তবে এটা কোথায় হবে? সে বিষয়ে রব্বে কারিমের আদেশে, আসমানে অবস্থিত বাইতুল মা’মুর এর নিচ বরাবর যমিনে একটি ঘর নির্মাণ করেন তার নাম ই কাবা ঘর । নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে, পুনর্নির্দেষ হল, এই গৃহ তওয়াফ কর। এটি প্রথম ঘর যাকে তৈরি করা হয়েছে ইবাদতের জন্যে। যখন হযরত নুহ (আঃ) এর যুগে মহাপ্লাবন হয় তখন বাইতুল্লাহর চিন্হটুকুও মুছে যায়।

দ্বিতীয়বারঃ আল্লাহ রব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে বাইতুল্লাহ শরীফ দ্বিতীয়বার পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। সে সময় কাবা ঘরের কোন প্রকার চিন্হ অবশিষ্ট ছিল না। হযরত জিবরাইল (আঃ) এসে হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আঃ)কে তাঁর পূর্বস্থানটি দেখিয়ে দেন। অতঃপর হযরত ইব্রাহিম (আঃ)স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে সঙ্গে নিয়ে কাবা গৃহের পুনর্নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন “স্বরণ কর, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আঃ) কাবা গৃহের স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিলঃ পরওয়ারদিগার! আমাদের থেকে কবুল কর। নিশ্চয় তুমি শ্রবণকারী,সর্বজ্ঞ। (সুরা বাকারা-১২৭)

তৃতীয়বারঃ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নবুওয়্যাতের পাঁচ বছর আগে তৃতীয় বারের মতো কোরাইশগন কর্তৃক পুনর্নির্মাণ হয়। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কর্তৃক নির্মিত সে যুগের কাবা ঘরের কোন ছাদ ছিল না। এর প্রাচীর সমুহও পর্যাপ্ত পরিমাণে উঁচু ছিল না। নয় হাত পরিমাণ এর উচ্চতা ছিল। পালাবদলের খেলায় কাবা ঘর তখন হয়ে পড়েছিল জরাজীর্ণ। নিচু ভূমিতে হওয়ায় বৃষ্টির পানিতে অভ্যন্তর পরিপূর্ণ হয়ে যেত। এতে কাবা ঘরকে নতুন করে পুনর্নির্মাণ এর পুত অভিপ্রায় উদিত হয় কোরাইশদের অন্তরে। কোরাইশ নেতৃবৃন্দ খানায়ে কাবাকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে নির্মাণ করার বিষয়ে যখন সবাই ঐক্যমত পোষন করল। রাসূল (সাঃ) এর মাতুল আব্দুল ওহাব বিন আমর মাখযুমী দাড়িয়ে বললেন,” বাইতুল্লাহর নির্মাণ কাজে যে অর্থ ব্যয় হবে তা যেন বৈধ পথে উপার্জিত হয়। চুরি সুদ ইত্যাদি পথের কোন টাকা এই কাজে ব্যয় করা যাবে না। আল্লাহ পবিত্র, আর তিনি পবিত্রকেই ভালোবাসেন। অতএব, তার গৃহ নির্মাণ কাজে পবিত্র সম্পদ ব্যয় কর”। আল্লাহর এই মহিমান্বিত কাজ থেকে যাতে কোন সম্প্রদায় বঞ্চিত না হয়, সে জন্য বাইতুল্লাহ শরীফের বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হলো। বনী আব্দে মান্নাফ ও বনী যোহরাকে কানার দরওয়াজার দিকে, বনী মখযুমী ও কোরাইশদেরকে হজরে আসওয়াদ ওরুকনে ইয়ামানীর দিকে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কোরাইশগন খবর পেল বন্দর নগরী জেদ্দায় এক বানিজ্যিক জাহাজ বিধস্ত হয়েছে। ওলীদ বিন মুগীরা সে জাহাজের কাষ্ঠসমুহ ক্রয় করে নিয়ে আসেন। ঐ জাহাজেই রামুক নামক জনৈক রোমান মিস্ত্রি ছিল। সে তাকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। অবশেষে বাইতুল্লাহ শরীফ ভাঙ্গার সময় হল। তখন কারো এতটুকু শক্তি ছিল না যে, সে বাইতুল্লাহ শরীফ ভাঙ্গার জন্যে হাত উত্তলন করবে। ওলীদ বিন মুগীরা হাতে কোদাল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহ!!  আমরা শুধু কল্যাণের জন্যেই এটি ভাঙছি। আমাদের কোন প্রকার অকল্যাণের ইচ্ছা নেই। এই বলে হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইমানী থেকে ভাঙ্গার কাজ আরম্ভ করলেন। মক্কা বাসিরা বলাবলি করতে লাগলো, যে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা কর!! যদি ওলীদের উপর কোন আসমানী আজাব অবতীর্ণ হয়, তাহলে আমরা ভাঙ্গা অংশটুকু মেরামত করে দিব। আর যদি তাকে কোন বালা স্পর্শ না করে তাহলে আমরা ওলীদের কাজে সাহায্য করবো। রাত ভোর হল। ওলীদ পুর্ণ সুস্থতার সহিত কোদাল নিয়ে মসজিদে হারামের কাজে চলে আসলো। এরপর লোকেরা বুঝতে পারলো যে এই কাজে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট রয়েছেন। ফলে সকলেই মনে প্রাণে কাজ সমাধানের জন্য এগিয়ে আসলো। কা’বার ভিত্তি খননের কাজ আরম্ভ হল। কিছুক্ষণ পর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কর্তৃক স্থাপিত কা’বার ভিত্তি প্রকাশ হয়ে পড়ল। একজন কোরাইশ ব্যক্তি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কর্তৃক প্রদত্ত ভিতে কোদাল দ্বারা আঘাত করলে বিরাট একটি শব্দ হয়, যা পুরো মক্কাকে প্রকম্পিত করে তুলে। ফলে তারা খনন কার্য হতে বিরত হয়ে তার উপর থেকে নির্মাণ কার্য আরম্ভ করল। যাদেরকে যে অংশ নির্মাণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা পাথর সংগ্রহ করে তাদের অংশ নির্মাণ করা শুরু করে দিল।বাইতুল্লাহ শরীফের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে, হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে পুনঃস্থাপনের ব্যাপারটি নিয়ে সকল গোত্র মতবিরোধ করে বসল। এক সময় পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠলো। প্রত্যেক গোত্রের লোকজন অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে যুদ্ধের মহড়া দিতে লাগলো। পাঁচ দিন ধরে চললো একই অবস্থা। কোন ফায়সালা হল না এই বিরোধের। অবশেষে কোরাইশদের মধ্যে সর্বাপ্রেক্ষা নির্ভরযোগ্য বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আবু উমাইয়া বিন মুগীরা মাখযুমী বললেন, আগামীকাল প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরওয়াজা দিয়ে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম প্রবেশ করবে, তাকেই এ বিরোধ নিষ্পত্তির মীমাংসাকারী হিসেবে মেনে নেওয়া হবে। উপস্থিত সবাই তার কথা পছন্দ করল এবং তার কথায় একমত হয়ে বলল ঠিক আছে। পরের দিন সকাল বেলা মসজিদে হারামে উপস্থিত হয়ে  দেখা গেল যে, মসজিদে হারামের দরওয়াজা সর্বপ্রথম  দিয়ে যে ব্যক্তি প্রবেশ করেছেন তিনি আর কেউ নন!! তিনি রহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ )। (বিঃদ্রঃ তিনি তখনও নবী হন নায়) নবীজীকে দেখে সবাই স্বমস্বরে বলে উঠলো যে, তিনি মুহাম্মাদ, তিনি আল আমীন-বিশ্বস্থ। আমরা তাকে মীমাংসাকারী রুুপে মেনে নিতে সম্মত আছি। তিনি মুহাম্মাদ তিনি বিশ্বাসী। হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) তখন নিজের একটি চাদর বিছিয়ে দিলেন এবং হাজরে আসওয়াদটি চাদরের উপর রেখে দিলেন এবং প্রত্যেক গোত্র প্রধানদেরকে ডেকে বললেন আপনারা সবাই চাদর ধরেন।যাতে করে এই মর্যাদাপুর্ণ খেদমত থেকে কেউ বঞ্চিত না হয়। সবাই তার এই ফায়সালা পসন্দ করল এবং সকলে চাদর ধরে যথাস্থানে নিয়ে গিয়ে  উপরে উঠাইল। আর বিশ্ব নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) স্ব হস্তে হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে পুনঃস্থাপন করলেন। এখানে একটি বিষয় আছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একটু চিন্তা করে দেখুন! এত সুন্দর ফায়সালা করা, এটা কোন সাধারণ মানুষের কাজ হতে পারে না।তিনি যে নবী হবেন, এটাও তার একটি আলামত। পবিত্র ঘর বাইতুল্লাহ শরীফের পবিত্র পাথর হাজরে আসওয়াদটি  নবীজীর মতো পুত পবিত্র মানুষকে দিয়ে করাবেন এটাও আল্লাহ তায়ালার একমাত্র ইচ্ছা ছিল। নতুবা কোরাইশদের এত বড় বড় নেতা থাকতে কারোরই সুযোগ হল না এবং সবাই তখন তার এই দূরদর্শী সমাধান দেখে খুব ই বিস্মিত হয়েছিল।

চতুর্থবারঃ নবী করিম ( সাঃ) যখন জিবিত ছিলেন তখন মাঝে মধ্যেই নবীজী বলতেন যদি কাবা ঘরটা ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করতে পারতাম? এবং হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পুর্ণ নির্মিত জায়গাটা কা’বার অন্তর্ভুক্ত করতে পারতাম? নবীজীর এমন কথা বলার কারণ হল, যখন কোরাইশগন কাবা ঘর তৃতীয়বার নির্মাণ করেছিলেন তখন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্থাপনের কিছু অংশ বাত পরে যায়, নবীজী সে অংশটুকুও কা’বার অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নবীজী তা করেন নাই।তার কারণ হল, নবীজী ভেবেছিলেন যে আমি যদি কাবা ঘর ভেঙ্গে দেই, তাহলে নও-মুসলিমরা অজ্ঞ লোকদের মনে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হবে তাই তিনি এ কাজ করেন নাই। (মাআরেফুল কুরআন)। তবে আমার মনে হয় নবীজী এই কাজটি না করেই ভালো হয়েছে। কারণ পরবর্তী লোকেরা মনে করবে এটা অনেক বড় সওয়াবের এর কাজ। নবীজীর সুন্নাত। এ মনে করে সবাই তখন বাইতুল্লাহ শরীফ বারবার ভাঙ্গত। পরবর্তীতে হুজুর (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর  আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর ভাগিনা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) এর খিলাফত এর সময় বাইতুল্লাহ শরীফ ভেঙ্গে নবী করিম (সাঃ) ইচ্ছা অনুযায়ী ইব্রাহিমী নির্মাণের উপর কাবা গৃহের পুনর্নির্মাণ করেন।

পঞ্চমবারঃ হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর স্বাসণ আমলে আবারও সে বাইতুল্লাহ শরীফ ভেঙ্গে দিয়ে কোরাইশদের স্থাপনের উপর পুনর্নির্মাণ করেন। অতঃপর হযরত ইমাম মালেক (রহ) ফতোয়া দেন যে  এখন থেকে কাবা ঘর আর ভাঙ্গা যাবে না। নতুবা যেই ক্ষমতায় আসবে সেই কাবা ঘর ভাঙ্গবে। অতএব, কাবা ঘর আর ভাঙ্গা যাবে না। তার এই দূর দর্শী কাল জয়ী  ফতোয়া সারা দুনিয়ায় সকল আলেমসমাজ সাধারণ মুসলমান একবাক্যে মেনে নিয়েছিল। (মা’আরেফুল কোরআন) কাবা ঘর এ পর্যন্ত পাঁচ বার নির্মাণ করা হয়েছে।

ইসলামিক লেখকঃ মুফতী আবুল কালাম আজাদ।